শীতের আগের শীত

পূজো তো এসেই গেল। চলেও যাবে। যাওয়া-আসার এই হাসি-কান্না ভরা কিস্‌সা তোলা থাকল আরেকদিনের জন্য। আজ বরং যাওয়ার পরের গল্পটাই করি একটু আপনাদের সাথে।

দুঃখু দুঃখু ভাবের সাথে শীতের নিশ্চয় একটা নিবিড় সম্পক্কো আছে। ছোটবেলায় মা দুগ্‌গা কৈলাশে ফিরে যাওয়ার পর প্রত্যেকটি দিন সকালবেলা ঘুম ভাঙার সাথে সাথে যখনই মনে হত, ধুস্‌ আবার ক-অ-বে পূজো আসবে, তখনই যেন একটু শীত শীত করে উঠত গা হাত পা। আরেকটু কুঁকড়ে-মুকড়ে শুয়ে পড়তাম আবার। এইভাবে চলতে চলতে কালী-ঠাকুরও (নাকি ঠাকরুণ) একদিন ফাঁকি দিয়ে চলে যেতেন। প্রথাগত উৎসবের মরশুম শেষ। দুঃখু দুঃখু ভাবও বেশি মনে। আর তাই বেশি শীত।

যদিও শীত আমার প্রিয় ঋতু, শীতের আগের প্রি-শীতটাও ফ্যালনা নয়। বর্ষার উচ্ছলতা আর শীতের গুরুগম্ভীর ভাবুকতাকে মেলাত এই অমোঘ হেমন্ত। দুদিন আগে যে সময় রোদ্দুরের প্রবল প্রতাপ উপেক্ষা করা যেত না, এখন সেসময় সন্ধ্যে নেমে গেছে। কিরকম একটা মনে করিয়ে দেওয়া যেন – এই আছে এই নেই। সাধে কি জীবনানন্দের কবিতায় বারবার ঘুরে ঘুরে আসে ‘কার্তিকের নীল কুয়াশা’? অনেককিছু মনে পরছে আজ।  ধোঁয়াশায় মুখ ঢেকে বিকেলগুলো দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া শুরু করত। মাঠ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে না আসতে ইচ্ছে করলেও ফিরে আসতে হত, কারন হঠাৎ একটু শীত-শীত করে উঠত যেন গা-হাত। পরীক্ষা-টরীক্ষা সব শেষ। একটা চাপহীন সময়। রাত্রে চাদর বা কাঁথায় সেঁধনোর আগে বার তিনেক পড়া সেবারের পুজাবার্ষিকীটা নিতে ভুল হতো না। সন্তু, জোজো বা অর্জুনের সাথে গল্প করতে করতে ঘুম নেমে আসত চোখে।

উৎসঃ ইন্টারনেট

ঘুমোবার আগে চোখ চলে যেত সামনের বাড়ির আকাশ-প্রদীপটার ওপর। যদিও ‘জিরো ওয়াট’ বাল্ব দিয়ে বানানো, নড়াচড়া করার কথা না, তবু সেসময় মনে হত, কুয়াশা মাখা আকাশ-প্রদীপ যেন অল্প অল্প দুলছে। ঘুমিয়ে পড়তাম। ভোরের দিকে ঘুম ভেঙ্গে যেত মোটা গলায় ভেসে আসা অল্প সুর মেশানো কোন চিৎকার শুনে। গ্রামের শেষপ্রান্তে থাকা আখড়ার গোস্বামীটি বেড়িয়ে পরেছেন, কার্ত্তিক মাসের রীতি অনুয়ারী কীর্তনে। চোখ খুলে প্রথমেই দেখতে পেতাম সেই আকাশ প্রদীপটি। এখন একটু ছোটো হয়ে গেছে, কুয়াশার প্রকোপে। কাঁথাটা মাথা অব্দি টেনে নিয়ে গুটিশুটি মেরে আবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে দেখতাম মা কখন যেন ঠিক ১ বা ২-এ চলা ফ্যানটাকে বন্ধ করে দিয়ে কাঁথাটাকে ঠিক করে দিয়ে গেছে।

কার্তিক ফুরোতে না ফুরোতে স্কুল খুলে যেত। মনখারাপ নিয়ে স্কুলে গেলেও বহুদিন পর দূরের বন্ধুদের কাছে পেয়ে দুঃখ ভুলতে সময় লাগত না। পূজোর পাওয়া-না-পাওয়ার গল্পে কলকল করে উঠত স্কুলপ্রাঙ্গন। সে গল্প শেষ হতে না হতেই এসে যেত গোষ্ঠ-জগদ্ধাত্রী পূজো। এ আবার বাড়ির পূজো। ‘বড় ধূম লেগেছে হৃৎকমলে’।iরঙচঙ করা গরু-বাছুর, ততোধিক রংচঙে কাপড়-জামায় তাদের পালক-পালিকা আর ঢোল-ভেঁপুর আওয়াজ-এর কার্নিভাল – এই ছিল আমার গোষ্ঠ। এখন শুনি লাউড-স্পিকারের আওয়াজে ঢোল-ভেঁপু মাইনরিটি হয়ে গেছে। কাকুর আড়তের কর্মচারী ‘নারান দাদু’র কাঁধে চড়ে একদিনের (নাকি এক সন্ধ্যের) গোষ্ঠমেলা থেকে পাঁপড় কিনে খাওয়া। অবশ্যই আমাকে এতটাও নির্লজ্জ ভাববেন না, যে আমি হাইস্কুলে পড়তেও দাদুর কাঁধে চড়েছি। এটা নিতান্তই শিশু বয়সে। কিন্তু চোখ বুঁজলে এটাই মনে পড়ে যে, কি করব? আমাদের মত ছোটদের না ছিল পুরুষ মহলে পূজোর ব্যবস্থাপনায় নিজেদের মতামত ব্যক্ত করার অধিকার (দুনিয়াদারি আজই ভালো করে বুঝে উঠতে পারলাম না, তখন তো কোন ছাড়) আর না ছিল মহিলামহলে পূজোর আয়োজনে কোন অধিকার (আমরা নাকি সবসময় কি যা-তা ঘেঁটে-ঘুটে বেড়াচ্ছি – সব ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যাবে)।iসারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করতাম, পুষ্পাঞ্জলির সময় পুষ্পাঞ্জলি দিতাম আর খাওয়ার সময় হাত-টাত ধুয়ে চাতালে পাত পাড়তাম সবার সাথে। ভাগ্যের ফেরে যদি কোন রাশভারী দাদু বা জেঠু পাশে বসতেন তাহলেই হত আরকি। ‘কি রে সারাদিন ছোটাছুটি করলেই হবে? শুনলাম হাফ্‌ইয়ারলিতে নম্বর কমে গেছে।’ বলুন তো ক্ষিদে পেটে কাঁহাতক এইসব ভালো লাগে? অবশ্য পাশে যদি বহুদিন দেখা না হওয়া কোনো জেঠিমা বা কাকিমা বসতেন তাহলে এগুলোই বদলে যেত, ‘রঞ্জুকে আর দেখাই যায় না, আসিস না কেন রে আমাদের বাড়ি’ – এইসবে। মুখে ভাত ভরে হুঁ-হাঁ ইত্যাদি বলে নিজেকে ব্যাস্ত প্রমান করে দিতাম।

উৎসঃ ইন্টারনেট

জগদ্ধাত্রী পূজো মিটল তো নবান (ভাল বাঙলায় নবান্ন)। নবান মানেই কলাপাতায় নতুন চালের গলা গলা ভাত আর তার সাথে কম করে ১০-১২ রকমের ভাজা – আলু, পটল, বড়ি, নারকোল মায় আঁখ অব্দি ভাজা! সকালের দিকে চাল মাখা তো ছিলই। অবশ্য আরও সকালে আরো একটি কঠিন কাজ সারতে হত – স্নান। ভাবছেন এতে আবার কষ্ট কি? করে দেখুন তো শীতের মরশুমে প্রথম সকালবেলায় চান, তাহলে বুঝবেন। অবশ্য নবানের নেমতন্ন খেতে এত সকালে স্নান করতে হত না। এইভাবে নবান, পান্ত-নবান  করতে করতে এসে যেত জাঁকিয়ে শীত। একে একে বেরোত সোয়েটার, মাফলার, জ্যাকেট, লেপ, দস্তানা। নাহ, এখন আর পুরোদস্তুর শীতের গল্প নয়, আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। আপনারাও বরং একটু আপনাদের শীত-প্রি-শীত বিলাসিতার গল্প করুন না আমার সাথে।

অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন …

এবারের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকটি (লন্ডন ২০১২) নানাকারণে স্মরণীয় হয়ে থাকলো। উসেইন বোল্টের স্বপ্নের দৌড়, মাইকেল ফেল্পসের নিজেকে সর্বকালের অন্যতম সেরা সাঁতারু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, একটি অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি পদক জেতার ভারতীয় রেকর্ড, আভিজাত্য আর আধুনিকতার মিশেলে অনবদ্য এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান – সবকিছু মিলে সত্যিই ‘The Greatest Show on the Earth’। তা বলে ভেবে বসবেন না যে আমি খেলোয়াড়দের নৈপুণ্য নিয়ে আমার অল্পবিদ্যার ভান্ডার খুলে বসব। আমি আজ এমন একটা জিনিস নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি, যেটা নজরে হয়ত অনেকেরই পরেছে, কিন্তু ঘটনাটা দ্রুত মাথা থেকে চলেও গিয়েছে। আমিও সেই দোষে দোষী, তবে জিনিসটা আবার আমাদের চোখের সামনে এনে দেয় আনন্দবাজার পত্রিকার ২৭ শ্রাবণ, ১৪১৯ এর এই খবরটি

সত্যিই, যখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সব দেশের প্রতিযোগীরা এক এক করে নিজ নিজ দেশের পতাকা কাঁধে হেটে যাচ্ছেন হঠাৎ একটা অদ্ভুত ‘দেশ’ চোখে পড়ল – Independent Olympic Athletes।

Photo Credit: Richard Mackson-USA TODAY Sports

এরা আবার কারা রে ভাই? যাকগে পরে দেখা যাবে। পরেও হয়ত দেখতাম না, কিন্তু শ্রী ‘গুওর মারিয়াল’ (Guor Marial) এর অসামান্য জীবনকাহিনি এই ফিরে দেখাটাই ঘটিয়ে দিল। ভাবতে বসলাম কি করে একটা মানুষের কোনো ‘দেশ’ না থেকে পারে? কোথাও না কোথাও তো জন্মেছিলেন উনি। এখন জন্মভূমি মানেই দেশ কিনা সে তর্কে না গিয়ে যেটা জানলাম সেটা হলো উনি এইমুহূর্তে পৃথিবীর সবথেকে টাটকা দেশের নাগরিক। দেশটা ‘দক্ষিণ সুদান’।.প্রায় ৬০ বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের শেষে সবেমাত্র স্বাধীন দেশ (জুলাই, ২০১১) হিসেবে জন্ম নিয়েছে দেশটি।

এই গৃহযুদ্ধের শুরুটা ছিল আরেকটা দেশের স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত। কে বলেছে ব্রিটিশ সিংহ শুধু দেশ ভাগ করেই বিভিন্ন দেশের শান্তি বিঘ্নিত করেছে? দরকার পরলে দেশ জুড়ে দিয়েও যে ঝামেলা বাধানো যায় তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বোধহয় ‘সুদান’।. চলে যাওয়ার আগে এতদিনের উত্তর ও দক্ষিন সুদান কে এক করে দিয়ে গেল ব্রিটিশ শক্তি এবং অবশ্যই সেখানকার বাসিন্দাদের মত না নিয়েই। ১৯৫৩ সালে স্বাধীন হওয়া দেশটির উত্তর ও দক্ষিন ভাগের মধ্যে লেগে গেল যুদ্ধ, বছর দুয়েক না যেতে যেতেই। ১৭ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, লোকবল সবদিক থেকেই দুর্বল দক্ষিন সুদানে মারা গেল ৫ লক্ষ মানুষ, যার ৮০ শতাংশই ছিল নিরস্ত্র। ৭২ সালে যুদ্ধ থামল বটে তবে তা আরো বড় আকারে বেশিদিন চলার জন্য। এবার চলল ২২ বছর – ১৯৮৩-২০০৫।.আর মানুষ নিকেশের হিসেবটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি, তফাৎটা হল ওটা ছিল গোটা বিশ্বের হিসেব এটা মাত্র একটি দেশের।

এইরকম একটা সময়ে এ দেশে জন্মান গুওর। জন্মেই দেখলেন ‘ক্ষুব্ধ সুদানভূমি’।.দেখলেন শিশুরা এখানে খেলনা হিসেবে পায় বন্দুক। পুরস্কার হিসেবে পায় বুলেট, তিরস্কার হিসেবেও জোটে বুলেট, তবে শরীরের মধ্যে। দেখলেন মানুষের ঘর মানে রিফিউজি ক্যাম্প, পরদেশে তো বটেই নিজদেশেও। দুর্ভিক্ষ, অশিক্ষা, শিশুমৃত্যুই দস্তুর। আর কি দেখলেন? দেখলেন, প্রাণ বাঁচাতে হলে দৌড়তে হবে। অনেকের মত শিশু গুওরও অপহৃত হলেন এবং দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে গেলেন। কিন্তু যে ছেলে পরে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে ম্যরাথন দৌড়বেন তাকে কি কেউ আটকে রাখতে পারে? তিনি পেরেছিলেন পরিবারের কাছে ফিরতে। অনেকেই, না না, – কেউই পারে না। কিন্তু এলে কি হবে? সুদানের পুলিশ ছাড়ল না, বাচ্ছা ছেলেটিকেও। এমন মারল যে হাসপাতালে কাটাতে হল কয়েক সপ্তাহ। সেই বেরোলেন জন্মভূমি থেকে আজও ফিরতে পারেননি। তার আগে অবশ্য তাকে ভাইবোনদের মৃত্যু দেখতে হয়েছে। তারপর মিশর হয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারে এসে পারলেন একটু থিতু হতে।

এ ছেলে তো যথার্থই বলবে “দৌড় কি করে খেলা হয়”? দৌড় যে শুধুমাত্র খেলা হতে পারেনা, সেটা আমাদের দেখিয়েছিল ছোট্ট আলি আর জারা। কিন্তু সে তো সিনেমা। গুওর যে কঠিন বাস্তব, আর তাই আরও কঠোর। না হলে, কেউ কি করে এতকিছুর পরেও সুদানের হয়ে অলিম্পিকে নামতে বলে, যেহেতু তার দেশ দক্ষিণ সুদানে কোনো অলিম্পিক কমিটি নেই!! আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির এই প্রস্তাবে গুওর বলেন যে সুদানের হয়ে তিনি নামবেন না, নামলে সেটা হতাশাজনক ও অস্বস্তিকর হবে তার ও দক্ষিণ সুদানের হাজার হাজার সেইসব মানুষের পক্ষে যারা স্বাধীনতার জন্য মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে গুওরের ভাইও ছিলেন। কেউ কি করে এতটা ইনসেনসিটিভ হতে পারে কে জানে! শেষমেষ আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি তাদের পাপ কিছুটা স্খালন করে গুওর-কে একজন স্বাধীন অলিম্পিক ক্রীড়াবিদ (Independent Olympic Athlete) হিসাবে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দিয়ে।

Photo by Darryl Webb / Reuters

আমি জানতে চাই না গুওর কি ফল করেছেন অলিম্পিক ম্যরাথনে। পদক হয়ত সে পায়নি। কিন্তু তবু গুওর আপনি আমার হিরো। জীবনে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষতে সদাব্যাস্ত এই আমরা কখনও আপনার লড়াইটা পুরোপুরি বুঝতে পারব না। বোঝার চেষ্টাটাও বৃথা। আপনার কাছে জীবন আর লড়াই আলাদা কিছু নয়, দুটোই আছে পাশাপাশি, হাত ধরাধরি করে। জীবনের ম্যারাথনে মাথা উঁচু করে দৌড়চ্ছেন আপনি, চিরকাল দৌড়বেনও জানি। চরৈবেতি, চরৈবেতি।।