এবারের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকটি (লন্ডন ২০১২) নানাকারণে স্মরণীয় হয়ে থাকলো। উসেইন বোল্টের স্বপ্নের দৌড়, মাইকেল ফেল্পসের নিজেকে সর্বকালের অন্যতম সেরা সাঁতারু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, একটি অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি পদক জেতার ভারতীয় রেকর্ড, আভিজাত্য আর আধুনিকতার মিশেলে অনবদ্য এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান – সবকিছু মিলে সত্যিই ‘The Greatest Show on the Earth’। তা বলে ভেবে বসবেন না যে আমি খেলোয়াড়দের নৈপুণ্য নিয়ে আমার অল্পবিদ্যার ভান্ডার খুলে বসব। আমি আজ এমন একটা জিনিস নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি, যেটা নজরে হয়ত অনেকেরই পরেছে, কিন্তু ঘটনাটা দ্রুত মাথা থেকে চলেও গিয়েছে। আমিও সেই দোষে দোষী, তবে জিনিসটা আবার আমাদের চোখের সামনে এনে দেয় আনন্দবাজার পত্রিকার ২৭ শ্রাবণ, ১৪১৯ এর এই খবরটি।
সত্যিই, যখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সব দেশের প্রতিযোগীরা এক এক করে নিজ নিজ দেশের পতাকা কাঁধে হেটে যাচ্ছেন হঠাৎ একটা অদ্ভুত ‘দেশ’ চোখে পড়ল – Independent Olympic Athletes।
এরা আবার কারা রে ভাই? যাকগে পরে দেখা যাবে। পরেও হয়ত দেখতাম না, কিন্তু শ্রী ‘গুওর মারিয়াল’ (Guor Marial) এর অসামান্য জীবনকাহিনি এই ফিরে দেখাটাই ঘটিয়ে দিল। ভাবতে বসলাম কি করে একটা মানুষের কোনো ‘দেশ’ না থেকে পারে? কোথাও না কোথাও তো জন্মেছিলেন উনি। এখন জন্মভূমি মানেই দেশ কিনা সে তর্কে না গিয়ে যেটা জানলাম সেটা হলো উনি এইমুহূর্তে পৃথিবীর সবথেকে টাটকা দেশের নাগরিক। দেশটা ‘দক্ষিণ সুদান’।.প্রায় ৬০ বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের শেষে সবেমাত্র স্বাধীন দেশ (জুলাই, ২০১১) হিসেবে জন্ম নিয়েছে দেশটি।
এই গৃহযুদ্ধের শুরুটা ছিল আরেকটা দেশের স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত। কে বলেছে ব্রিটিশ সিংহ শুধু দেশ ভাগ করেই বিভিন্ন দেশের শান্তি বিঘ্নিত করেছে? দরকার পরলে দেশ জুড়ে দিয়েও যে ঝামেলা বাধানো যায় তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বোধহয় ‘সুদান’।. চলে যাওয়ার আগে এতদিনের উত্তর ও দক্ষিন সুদান কে এক করে দিয়ে গেল ব্রিটিশ শক্তি এবং অবশ্যই সেখানকার বাসিন্দাদের মত না নিয়েই। ১৯৫৩ সালে স্বাধীন হওয়া দেশটির উত্তর ও দক্ষিন ভাগের মধ্যে লেগে গেল যুদ্ধ, বছর দুয়েক না যেতে যেতেই। ১৭ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, লোকবল সবদিক থেকেই দুর্বল দক্ষিন সুদানে মারা গেল ৫ লক্ষ মানুষ, যার ৮০ শতাংশই ছিল নিরস্ত্র। ৭২ সালে যুদ্ধ থামল বটে তবে তা আরো বড় আকারে বেশিদিন চলার জন্য। এবার চলল ২২ বছর – ১৯৮৩-২০০৫।.আর মানুষ নিকেশের হিসেবটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি, তফাৎটা হল ওটা ছিল গোটা বিশ্বের হিসেব এটা মাত্র একটি দেশের।
এইরকম একটা সময়ে এ দেশে জন্মান গুওর। জন্মেই দেখলেন ‘ক্ষুব্ধ সুদানভূমি’।.দেখলেন শিশুরা এখানে খেলনা হিসেবে পায় বন্দুক। পুরস্কার হিসেবে পায় বুলেট, তিরস্কার হিসেবেও জোটে বুলেট, তবে শরীরের মধ্যে। দেখলেন মানুষের ঘর মানে রিফিউজি ক্যাম্প, পরদেশে তো বটেই নিজদেশেও। দুর্ভিক্ষ, অশিক্ষা, শিশুমৃত্যুই দস্তুর। আর কি দেখলেন? দেখলেন, প্রাণ বাঁচাতে হলে দৌড়তে হবে। অনেকের মত শিশু গুওরও অপহৃত হলেন এবং দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে গেলেন। কিন্তু যে ছেলে পরে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে ম্যরাথন দৌড়বেন তাকে কি কেউ আটকে রাখতে পারে? তিনি পেরেছিলেন পরিবারের কাছে ফিরতে। অনেকেই, না না, – কেউই পারে না। কিন্তু এলে কি হবে? সুদানের পুলিশ ছাড়ল না, বাচ্ছা ছেলেটিকেও। এমন মারল যে হাসপাতালে কাটাতে হল কয়েক সপ্তাহ। সেই বেরোলেন জন্মভূমি থেকে আজও ফিরতে পারেননি। তার আগে অবশ্য তাকে ভাইবোনদের মৃত্যু দেখতে হয়েছে। তারপর মিশর হয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারে এসে পারলেন একটু থিতু হতে।
এ ছেলে তো যথার্থই বলবে “দৌড় কি করে খেলা হয়”? দৌড় যে শুধুমাত্র খেলা হতে পারেনা, সেটা আমাদের দেখিয়েছিল ছোট্ট আলি আর জারা। কিন্তু সে তো সিনেমা। গুওর যে কঠিন বাস্তব, আর তাই আরও কঠোর। না হলে, কেউ কি করে এতকিছুর পরেও সুদানের হয়ে অলিম্পিকে নামতে বলে, যেহেতু তার দেশ দক্ষিণ সুদানে কোনো অলিম্পিক কমিটি নেই!! আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির এই প্রস্তাবে গুওর বলেন যে সুদানের হয়ে তিনি নামবেন না, নামলে সেটা হতাশাজনক ও অস্বস্তিকর হবে তার ও দক্ষিণ সুদানের হাজার হাজার সেইসব মানুষের পক্ষে যারা স্বাধীনতার জন্য মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে গুওরের ভাইও ছিলেন। কেউ কি করে এতটা ইনসেনসিটিভ হতে পারে কে জানে! শেষমেষ আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি তাদের পাপ কিছুটা স্খালন করে গুওর-কে একজন স্বাধীন অলিম্পিক ক্রীড়াবিদ (Independent Olympic Athlete) হিসাবে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দিয়ে।
আমি জানতে চাই না গুওর কি ফল করেছেন অলিম্পিক ম্যরাথনে। পদক হয়ত সে পায়নি। কিন্তু তবু গুওর আপনি আমার হিরো। জীবনে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষতে সদাব্যাস্ত এই আমরা কখনও আপনার লড়াইটা পুরোপুরি বুঝতে পারব না। বোঝার চেষ্টাটাও বৃথা। আপনার কাছে জীবন আর লড়াই আলাদা কিছু নয়, দুটোই আছে পাশাপাশি, হাত ধরাধরি করে। জীবনের ম্যারাথনে মাথা উঁচু করে দৌড়চ্ছেন আপনি, চিরকাল দৌড়বেনও জানি। চরৈবেতি, চরৈবেতি।।
সুন্দর তথ্যমূলক লেখা আবির। খুব ভালো লাগল পড়ে।
থ্যাঙ্কু কুন্তলাদি। এই লেখাটা চেষ্টা করেছি, একটু তথ্যসমৃদ্ধ করে তোলার। যদিও তথ্য দিয়ে কি আর এই মানুষটির লড়াইকে মাপা যাবে! তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুব ভালো লাগলো।
শিরোনাম টি যথাযত হযেছে … খুব ই যথাযত … সময়োচিত নিবন্ধ .. !
ধন্যবাদ ভাই। লেখাখানা তোর পছন্দ হওয়ায় আমি যারপরনাই আনন্দিত।।