কাকাবাবু হেরে গেলেন।।

ছেলেবেলায় যে দুটো কবিতা বলতে না পেরে নিজেকে বেশ বড়সড় একটা দুচ্ছাই মনে হত, তার একটা হল ‘কেউ কথা রাখেনি’। ১৫ই আগস্ট বা ২৬-শে জানুয়ারি বা অন্য কোনো তিথিতে ছোটোদের জন্য বরাদ্দ ‘বীরপুরুষ’ বা ‘পূজারিণী’ আবৃত্তি করে এসে যখন দেখতাম একটু বড়রা গলা কাঁপিয়ে বোষ্টুমি, নাদের আলী বা বরুণার কথা না রাখার কথা পারছে, তখন, সত্যি বলছি, আমারও ঐ না দেখা নাদের আলীকে বলতে ইচ্ছে করত, ‘আমি আর কত বড় হবো’? সুনীলবাবুর কবিতার সঙ্গে পরিচয়টা অবশ্য খুব বেশিদূর এগোয়নি আর। দোষ আমারই। আধুনিক কবিতার আধুনিকতার জালে হাঁসফাঁস করতাম সবসময়ই।

অবশ্য তার আগেই, ওনার গদ্যের সাথে ভাব হয়ে গেছে। সৌজন্যে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা। কাকাবাবুকে ভয় পেতাম, সন্তুকে পেছনপাকা লাগত আর জোজো ছিল একদম কাছের মানুষ – বম্বাস্টিক গুল মারা আর বেজায় খানেওয়ালা দুটো কারনেই। পূজোবার্ষিকীটা পেয়ে প্রথমেই যেটা খুলতাম সেটা কাকাবাবু, এমনকি সূচীপত্রেরও আগে। আজও যেকোনো পূজাবার্ষিকী পেলেই প্রথমে যেটা খুলি সেটা হল সুনীল গাঙ্গুলীর লেখা। আর সেটা হবে না।

তখন গরমের ছুটি। পশ্চিমবঙ্গের এক নামীদামী কলেজে ১১ ক্লাসে অঙ্কে সদ্য ফেল করেছি। অঙ্কের গিঁটকিরি খোলার জন্য স্ব-আরোপিত বন্দিদশা চালাচ্ছি। ছুটিতে বাড়ি না গিয়ে কলকাতায় মাসীর বাড়িতে থেকে টিউশনে যাচ্ছি আর অঙ্ক নিয়ে লড়ছি। মেসোমশাই অফিসের লাইব্রেরী থেকে একদিন একটা বই নিয়ে এলেন। বেশ মোটা, ওপরটা নীল রঙের প্রচ্ছদ, গঙ্গার ঘাটের ছবি, বাঁধানো চাতালে এক বাবু আর বিবি বসে আছে। অঙ্কে বোর হয়ে একদিন দুপুরে হাতের কাছে বইটা পেয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম। প্রথম পাতা থেকেই মন ফেরাতে পারলাম না। তখনো জানিনা এটা দ্বিতীয় খন্ড। কিছুটা পড়ে কি মনে হওয়ায় খেয়াল করলাম সেটা। নাহ্‌, এ বই তো প্রথম থেকে না পড়লে চলছে না। লজ্জার মাথা খেয়ে মেসোমশাইকে বলেই ফেললাম, ‘একটু ‘প্রথম আলোর’ ফার্স্ট পার্টটা এনে দিতে পারবে?’ মেসোমশাই মুঁচকি হাসলেন যেন। ভাবলেন এ ছেলের অঙ্ক শেখা হয়েছে আরকি। আর অঙ্ক! যাকে ‘প্রথম আলো’তে ধরেছে তার কিবা অঙ্ক, কিবা ফিজিক্স। বইটা পড়ি আর ভাবি, এরকমও লেখা সম্ভব! নবজাগরণ-টণ নিয়ে তো আগেও পরেছি প্রচুর। সবই ইতিহাস বই – একটু ভারী। আর এ তো গল্পকথা। এত সহজ তাহলে নবজাগরণ ব্যাপারটা? আর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে যে লোকে বলে শক্তি-সুনীলেরা রবীন্দ্রবিদ্বেষী! বরং অনেক তথাকথিত রাবীন্দ্রিকের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের আত্তীকরণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এ বেশী। বিমল মিত্রের পরই আমি ঔপন্যাসিক হিসেবে সুনীল গাঙ্গুলীকে বসিয়ে ফেললাম, আমার কাছে। এই অবাক ভালোলাগা পরে পরে আরো বাড়িয়ে দিল ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’।iএবং প্রত্যেকটা উপন্যাসই পড়তে পড়তে এটাই মনে হত, এরকমও লেখা যায়!

পরে পরে অনেক ক্ষেত্রে তার মতের সাথে আমার মত মেলেনি। কিন্তু সেসবের সাথে সত্যিই কি তার লেখনীর কোনো সম্পর্ক আছে? তার লেখা তার যায়গায় আর তার মত তার যায়গায়। ভালোবেসেছি তার লেখাকে, কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তিনি নিজের জীবন নিজের মত করেই বেঁচেছেন। মতামত যা ছিল স্পষ্ট। সে তার কিছু কিছু কার্যক্রম কারো কারো ভালো লাগুক চাই না লাগুক। ধরি মাছ না ছুই পানি – এ জিনিস তার মধ্যে ছিল না। একজন সামান্য আঞ্চলিক সাহিত্যের লেখক – কিন্তু মৃত্যুকালেও তার ক্যারিশ্‌মার জোরে লাল-নীল-সবুজ সব এক হয়ে গেলো। হতে পারে তার পিছনে আছে রাজার নীতির জটিল-কুটিল অঙ্ক, কিন্তু শেষপর্যন্ত মেলালেন তো তিনি! অতএব, আমার অঙ্কের সাধনা গুলিয়ে দেওয়া হে কাকাবাবু, আদতে কিন্তু আপনি হারেননি, কাকাবাবু যে হারতে পারেন না।।

উৎসঃ গুগ্‌ল ইমেজেস্‌।

পুনশ্চঃ ছোটবেলার অপর শিহরণসৃষ্টিকারী কবিতাটি ছিল – ‘প্রিয়তমাসু’ – শ্রী সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা।

যাত্রাপথ।।

যাত্রা আপনারা কয়জন দেখেছেন বা আদৌ দেখবার ইচ্ছা রাখেন জানিনা, আমার কিন্তু যাত্রা ব্যাপারটা বেশ লাগে। পুরো প্যাকেজটাই অসাধারণ। শুরু হয় পোস্টার দিয়ে। ওয়ান ফাইন মর্ণিং, চোখে পড়বে, বাংলা-হিন্দী সিনেমা, গুপ্তরোগ বা বিশ্ববিখ্যাত সার্কাস এরকম হাজার কিসিমের পোস্টারের ভিড় সামলে উঁকি দিচ্ছে পৈশাচিক হাঁসি নিয়ে ক্রুর ভিলেন বা সুন্দরী নায়িকার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা বাবরি চুলের নায়ক। পোস্টারের লে-আউটটা মোটামুটি এরকম –

১. টপ-রাইট – হয় ভিলেন না হয় নায়ক-নায়িকার (ডিপেন্ড করছে কে বেশি বিখ্যাত তার ওপর) বড়সড় ছবি।
২. মাঝখান – (ঢেউখেলান ফন্টে) অমুক অপেরা (যেমন, জগৎজয়ী বা মুক্তমঞ্জরী) নিবেদিত এবছরের সর্বশ্রেষ্ঠ সামাজিক/ঐতিহাসিক/পৌরাণিক যাত্রাপালা তমুক (যেমন মীরার বঁধূয়া বা রোগা স্বামীর দারোগা বউ বা শ্বাশুড়ী বিশ্বসুন্দরী)।
৩. বটম-লেফট – ভিলেন বা নায়ক-নায়িকার মধ্যে যার স্থান টপ-রাইটে হয়নি তার বা তাদের ছবি। সঙ্গে আর দুএকজন স্বল্পনামী কুশীলবের ছবিও থাকতে পারে। তার ডানদিকে যাত্রার স্থান-কাল ও প্রবেশমূল্য। টিকিটের দামটা নির্ভর করত আপনি ‘জমিনে’ বসতে চান না ‘চেয়ারে’ তার ওপর, আর টিকিট  ‘অগ্রিম’ কাটবেন না যাত্রার দিন ‘কাউন্টারে’ কাটবেন তার ওপর।
৪. টপ-লেফট এ সাধারণত যাত্রা যারা আয়োজন করছে তাদের নাম থাকত। যেমন ধরুন, ‘কীর্ণাহার তরুন সমিতির সপ্তম বর্ষের নিবেদন … ’ ইত্যাদি। এখানে একটা অপশনাল পার্টও ছিল। সেটা জাহির করার চেষ্টা করত যাত্রাপালাটি সংগঠিত করার পিছনের মহৎ কারণটি। সেটা ‘এলাকাবাসীর সাহায্যার্থে নতুন অ্যাম্বুলেন্স ক্রয় প্রকল্প’ও হতে পারে আবার ‘গ্রামের সুপ্রাচীন মনসা-মন্দিরটির পুনরুজ্জীবন প্রকল্প’ও হতে পারে।
৫. এছাড়াও পোস্টারের টপ ও বটম মার্জিনের জায়গাদুটিতেও কয়েকটি কথা লেখা থাকত যেগুলো মোটামুটি সব যাত্রার পোস্টারেই থাকত এবং দু একটি শব্দ ছাড়া বিশেষ চেঞ্জও হত না। উপরেরটায় লেখা থাকত – ‘আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ। এক (বা দুই) রাত্রিব্যাপী বিরাট যাত্রানুষ্ঠান’।iআর নিচেরটায় লেখা থাকত – ১. অগ্রিম টিকিটের উপর লটারির মাধ্যমে ১৫ টি দেওয়াল ঘড়ি (বা ২টি সাইকেল) পুরস্কার থাকিবে। ২. যাতায়াতের জন্য বাসের সুব্যাবস্থা থাকিবে। ইনভেরিয়েবলি, সাধুভাষায় এই কথাকটি লেখা থাকার জন্য আমার মনে হত, এই মার্জিনটা বোধহয় তৈরিই থাকে, যাত্রার নাম-টাম গুলো পরে  অর্ডার অনুয়ারী বসানো হয়।

এতো গেল প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচার। এবারে আসুন শব্দব্রহ্মের প্রয়োগে। মূল যাত্রানুষ্ঠানের মাস-দুয়েক (ইয়েস ২ মাস) আগে হঠাৎ কোনদিন শুনতে পাব, (কিঞ্চিৎ ক্যাঁ কো জাতীয় মাইক্রোফোনোচিত আওয়াজের পর) “বন্ধুগন, বন্ধুগন, বন্ধুগন (বান্ধবীদের কেন উদ্দেশ্য করা হয়না কে জানে) আর মাত্র কয়েকদিন পর, আআর মাত্র কয়েকদিন পর কীর্ণাহার K.S.A. ময়দান মাতাতে আসছে গ্রাম-বাংলা-শহর-বাজার তোলপাড় করা যাত্রাপালা …”।iএরপর যাত্রার ক্যাসেট থেকে একটু চড়া গলার সংলাপ, সাথে ঝ্যাঁকোর-ঝ্যাঁকোর আওয়াজ। তারপর আবার – “সেসঠাংসে (শ্রেষ্ঠাংশে) রয়েছেন যাত্রাজগতের মহানায়ক সামথিং কুমার, তার সাথে রয়েছেন টলিউড-বলিউডের দুষ্টুমিষ্টি নায়িকা মিস্‌ সামওয়ান …”।iমাঝে মাঝে শুধুই “আর মাত্র কয়েকদিন পর, আআর মাত্র কয়েকদিন পর” বলে থেমে যাওয়া। অবিশ্যি, মাঝে মাঝে দু-একটা কাজের কথাও কানে চলে আসে। যেমন – “এই বিড়িটা কে নিলি রে?” বা “এই এখন জ্বালাস না মাইরি” ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর মোটামুটি যাত্রার মাসখানেক আগে থেকে শুরু হয়ে যায় চলমান গাড়িতে প্রচারাভিযান। একটা লঝ্‌ঝরে ম্যাটাডোরের চারিদিকে ছোটবড় হাজার কিসিমের পোস্টার লাগানো থাকে। আর তার সাথে ছাদের দুদিকে দুটো চোঙা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ে কয়েকজন। বুলি মোটামুটি একইরকম থাকে, তবে তার সাথে এই কথাগুলো আরও যোগ হয় – “আমাদের প্রচারগাড়ী আর কিছুক্ষণের মধ্যে আপনাদের অ্যালাকা ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাবে, আপনারা তাড়াতাড়ি নিজ নিজ টিকিট সংগ্রহ করে নিন”।

উৎসঃ ইন্টারনেট – চিনতে পারেন? ইনি মহামহিম বুশ্‌। উনি অবশ্য হাতে আংটি পড়তেন কিনা জানিনা।

এইভাবে একদিন ‘দ্য ডে’ এসে পড়ে। অবশ্য তার দুদিন আগে থেকেই আমাদের খেলাধূলো বন্ধ হয়ে যেত। এর দুটো কারন ছিল। প্রথমটা মাঠের আয়তন কমে যাওয়া। মানে, যে বিশাল K.S.A. (Kirnahar Sports Association) এর মাঠে আমরা সমেত কম করে ৫-টা দল খেলাধূলো করতাম সেটারই অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ টিনে ঘেরা পড়তো। আর দ্বিতীয় কারনটা ছিল, এইকটা দিন ছেলেপিলে টিনের বাইরের থেকে টিনের ভেতরের যায়গাটার প্রতিই বেশি আকর্ষণ বোধ করত। স্টেজ কোথায় হচ্ছে, কত উঁচু, সবাই দেখতে পাবে তো, ঐতো স্টেজে ওঠার সিঁড়ি, তার মানে ওইখানে গ্রিনরুম হবে, এরকম হাজারো সওয়াল-জবাব চলতে থাকে মনের মধ্যে। তখন কিবা ক্রিকেট, কিবা ফুটবল, কিবা পিট্টু।

যাই হোক, যাত্রার দিন তো, ‘আর মাত্র কয়েক ঘন্টা, আআর মাত্র কয়েক ঘন্টা’ শুনে সাতসকালে ঘুম ভাঙ্গে। বাড়ির পড়া তো মার গোলি, কিন্তু ইস্কুল? সে তো ছাড়ান নেই, মনের কষ্ট মনেই চেপে রেখে যেতাম স্কুল। সেদিনের যাওয়াটা যেন, ট্র্যাজিক সিনেমার শেষটুকুর মত। সবাই চলতে হয় চলেছে, মন-টন নেই কারোর। যেতে যেতে আবার দেখতাম প্রাইমারী স্কুলে ছুটি। আরে ছুটি হবে না-ই বা কেন? ওটাই তো যাত্রাপার্টির ঘাঁটি। স্কুলের পাঁচিলের ধারে দুটো ইয়াব্বড়ো উনুনে হাঁউমাউ আগুন, আর তার ওপর প্রমান সাইজের দুটো কড়াই। উফ্‌ফ, এইসব ফেলে ইস্কুল! পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর কেন? কোন কোন বার দেখেছি প্রাইমারী স্কুলের পাশের মাঠে বড়সড় একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে বেশকিছু অনামী কুশীলব হাজির। নামী-দামীরা এখন বোলপুরে ভালো জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছেন। তারা ঠিক ফার্স্ট সিনের আগে গাড়ি করে এসে, হয় ধাঁ করে স্টেজে (যদি মেকাপ হয়ে গিয়ে থাকে) না হয় গ্রীণরুমে (উল্টোটা হলে)।iএই অনামীদের মাঝে-সাঝে দেখেও ফেলেছি, হয়তো কেউ লুঙ্গি, স্যন্ডো পড়ে আর কোমরে গামছা জরিয়ে দাঁতন করছেন। কাল রাত্রে শো-এর পর মেদিনীপুর বা মালদা থেকে ওভারনাইট বাসে আসা তো, কাজেই একটু পরিষ্কার হয়ে নেওয়া দরকার। ফ্রেশ হয়ে এখন একটু ঘুমোতে না পেলে রাত্তিরে টানতে পারবেন না তো। তাদের থাকা-খাওয়া তো বুঝতেই পারছেন প্রাইমারী স্কুলে ব্যবস্থা করা হয়েছে। কখনও যদি স্কুলের পথে এসবের দেখা নাও পেতাম, স্কুলে কি করে জানিনা, ঠিক আপ-টু-ডেট খবরাখবর পেয়ে যেতাম। তবে হ্যাঁ শিবচন্দ্র হাইস্কুল সেদিন বেশিক্ষণ আঁটকে রাখতো না, তাড়াতাড়ি চলে আসতাম বাড়ি।

তড়িঘড়ি নাকে-মুখে কিছু গুঁজে দে ছুট মাঠের দিকে। আজ খেলা তো দূরের কথা, ব্যাট-বলই বেরোয় না। দ্রুত প্যান্ডেলের মধ্যে ঢুকে দেখি, অলরেডি অনেকেই হাজির হয়ে গেছে। অনেকেই, বলতে খেলার সঙ্গীরা। চেটেপুটে উপভোগ করে নেওয়া আরকি, ফিনিশিং টাচ্‌টা। ক্লাবের দাদাদের তাড়া খেয়ে বেরিয়ে আসার আগে শেষবারের মত দেখে নিতাম বিশাল কিন্তু ফাঁকা স্টেজ আর ঘিরে ফেলা মাঠটা। সেখান থেকে বেড়িয়ে সোজা বাড়ি। বাড়ির কাছে তখন হৈ-হৈ কাণ্ড রৈ-রৈ ব্যাপার। ‘যাতায়াতের সুব্যবস্থা’কারী বাসগুলো একে একে আসতে শুরু করেছে। মাইকে অহরহ তার ঘোষণা – ‘লাভপুর-মৌগাঁ-বাকুল-গোমাই থেকে আসা মা জগদ্ধাত্রীর ড্রাইভারকে বলা হচ্ছে বাসটা একটু এগিয়ে দাঁড় করাতে।’ কাকস্য পরিবেদনা। ছাদে-বাম্পারে থাকা বাস থেকে জনতা তখন নামতে লেগেছে। কাজেই বাস নট নড়ন-চড়ন। এদিকে পিছনে ‘নতুনগ্রাম-ফুটিসাঁকো-কালকেপুর-দাসকলগ্রাম’ থেকে আসা ‘পারভেজ’ এন্তার হর্ণ বাজিয়ে যাচ্ছে। সে সুবিধামত জায়গা পায়নি লোক নামানোর। সবমিলিয়ে সন্ধ্যেটার একটা জমাটি শুরু।

এরপরের পর্বটা খোদ আমাদের বাড়িতেই। অবস্থানগত একটা বিশাল সুবিধা আছে আমাদের বাড়ির। বাসস্টপ থেকে যাত্রার মাঠে যাওয়ার রাস্তার ঠিক মুখেই আমাদের বাড়ি। আর বাড়ির সামনের দিকে আমার বাবার দোকান। সবমিলিয়ে যাত্রার ‘ওয়ান অফ্‌ দ্য টিকিট কাউন্টারস্‌’ হওয়ার একদম আইডিয়াল জায়গা। বাড়ি ফিরেই দেখতে পেতাম বাবা দোকান-টোকান গুটিয়ে ফেলেছে আর সামনের কোলাপসিবল্‌ গেটটা টেনে দিয়ে তার পিছনে সবুজ রঙের টিকিটের বান্ডিল আর টিনের বাক্সে কিছু রেজকি গুছিয়ে বসেছে ক্লাবের দায়িত্ববান লোকজন। রাস্তার উল্টোদিকে বিল্টুদের বাড়িতে বসত এরকমই আরেকটা কাউন্টার। টিকিট বিক্রি শুরু হলে এই দুই কাউন্টারের মধ্যে চোরা টেনশনটা দেখবার মত হতো। আমাদের চর শুধু বিল্টুদের টিকিট বিক্রির খবরই আনছে না, আমাদের খবরও যে ওপাড়ায় চলে যাচ্ছে সে খবরটাও চিন্তাক্লিষ্ট মুখে শোনাচ্ছে। যেন চর শুধু আমরাই লাগাব, ওদের চর ফিট করার অধিকার নেই! এমনকি রীতিমত খদ্দের ভাঙ্গাতেও দেখেছি একে অপরকে। অবশ্য টিকিট বিক্রি শেষ হলে এই রেষারেষির রেশমাত্র থাকত না। তখন সবার মুখে একই বান্ডিলের বিড়ি। আমার অবশ্য শেষের জন্য ওয়েট করলে চলবে না। বাহ্‌, বাড়ির ভিতরে দেখতে হবে না, প্রস্তুতি কতদূর। নিজেকেও তো রেডি হতে হবে।

অল্প কিছু খেয়ে নিয়ে, মাঙ্কি ক্যাপ ফুল সোয়েটার সমেত ‘I am ready’। মা-ঠাকুমা-কাকীমা সমেত গোটা দলকে আসরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসত টর্চ হাতে মেজকাকা। সঙ্গে থাকত লেবেঞ্চুস আর নাড়ু মোড়লের ডালমুট। সংখ্যাগরিষ্ঠের মত ‘জমিন’-এই বসতাম। দাম বেশি হলেও চেয়ারটা ঠিক সুবিধেজনক অপশন ছিল না। পিছনে জমিনের দর্শকদের যাতে অসুবিধে না হয় তার জন্য চেয়ারগুলো বেশিরভাগ সময়ই স্টেজের সামনে না হয়ে পাশের দিকে হত। তাই চেয়ারে বসে ভালো করে দেখাও যেত না। মোদ্দা কথা চেয়ার মোটামুটি ফাঁকাই থাকত। যাই হোক, প্রথমে লটারী করে সাইকেল, ঘড়ি যা দেওয়ার দিয়ে দেওয়া হত। তারপর ক্লাবের পোর্টফোলিওরা ছোটখাট বক্তিমে শুরু করতেন। তবে দর্শক একটু বেশিমাত্রায় উশখুশ করে উঠলেই বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিতেন। তারপর গুনে গুনে তিনখানি ঘন্টা ও যাত্রাশুরু।

তারপর ঘন্টা-তিনেক কোথা দিয়ে কেটে যেত কে জানে। বেশি ছোটতে, যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে আমি ঠিক ঘুমিয়ে পড়তাম। এখন পাশের ঘরে কেউ জোরে কথা বললে ঘুম বলে আসব না, আর তখন ঐ ঝাঁই-ঝপ্পড়ের মধ্যেও কি করে ঘুমিয়ে পড়তাম কে জানে। হঠাৎ করে দর্শককুলের কোনো সমস্বর আওয়াজ (যেমনঃ- ‘ইস্‌স একদম মেরে ফেলল’) শুনে জেগে উঠে পরিস্থিতি বুঝবার চেষ্টা করতাম ঠিকই, কিন্তু দ্রুত রণে ভঙ্গ দিতাম। তবে এটুকু বুঝতে পারতাম, যে ঘুমটা বসে বসে শুরু হয়েছিল, সেটা বদলে গেছে। মাথাটা মায়ের কোলে, পায়ে একটা চাদর – এইসব আরকি। তারপর ঢুলে ঢুলে মাঝরাত্তিরে বাড়ি ফেরা। একটু বড় হওয়ার পর অবশ্য ঠিক ঘুমিয়ে পড়তাম না। তবে মূল যাত্রার থেকেও বেশী আশপাশটা দেখতে থাকতাম। হাজার হাজার বিড়ি কিরকম জ্বলছে-নিভছে, তাদের ধোঁয়া কিরকম প্যান্ডেলের ছাদে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে আর বেরোতে পারছে না, বিড়ির মালিকরা কিরকম ভদ্দরলোকের মত বসে যাত্রা দেখতে শুরু করেও টেনশনের মুহূর্তে বিড়ি হাতে উবু হয়ে বসে পড়ল, বা বিড়ির মালিকের বৌ কিরকম স্বামীকে লুকিয়ে আঁচল দিয়ে দু-ফোঁটা চোখের জল মুছে নিল, এইসব।

আমার যাত্রাপথ এবার শেষ করি। তবে আমি যে শুধু দর্শকই ছিলাম না, মাঝে-সাঝে ‘কুঁজোরও যে চিৎ হয়ে শোওয়ার সখ’ হয় সেটার প্রমাণ এই ছবি।

স্থান – কীর্ণাহার তরুন সমিতির স্টেজের পিছন, কাল- আমি তখন ক্লাস ফাইভ – পূজোর সময় ক্লাবের ছেলেরা মিলে যে যাত্রা করত সেরকমই একটা যাত্রায়, পাত্র – নটসূর্য আবিরকুমার উরফ্‌ ‘রক্তে রাঙা মাটি’ যাত্রার রাজপুত্র।