কাকাবাবু হেরে গেলেন।।

ছেলেবেলায় যে দুটো কবিতা বলতে না পেরে নিজেকে বেশ বড়সড় একটা দুচ্ছাই মনে হত, তার একটা হল ‘কেউ কথা রাখেনি’। ১৫ই আগস্ট বা ২৬-শে জানুয়ারি বা অন্য কোনো তিথিতে ছোটোদের জন্য বরাদ্দ ‘বীরপুরুষ’ বা ‘পূজারিণী’ আবৃত্তি করে এসে যখন দেখতাম একটু বড়রা গলা কাঁপিয়ে বোষ্টুমি, নাদের আলী বা বরুণার কথা না রাখার কথা পারছে, তখন, সত্যি বলছি, আমারও ঐ না দেখা নাদের আলীকে বলতে ইচ্ছে করত, ‘আমি আর কত বড় হবো’? সুনীলবাবুর কবিতার সঙ্গে পরিচয়টা অবশ্য খুব বেশিদূর এগোয়নি আর। দোষ আমারই। আধুনিক কবিতার আধুনিকতার জালে হাঁসফাঁস করতাম সবসময়ই।

অবশ্য তার আগেই, ওনার গদ্যের সাথে ভাব হয়ে গেছে। সৌজন্যে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা। কাকাবাবুকে ভয় পেতাম, সন্তুকে পেছনপাকা লাগত আর জোজো ছিল একদম কাছের মানুষ – বম্বাস্টিক গুল মারা আর বেজায় খানেওয়ালা দুটো কারনেই। পূজোবার্ষিকীটা পেয়ে প্রথমেই যেটা খুলতাম সেটা কাকাবাবু, এমনকি সূচীপত্রেরও আগে। আজও যেকোনো পূজাবার্ষিকী পেলেই প্রথমে যেটা খুলি সেটা হল সুনীল গাঙ্গুলীর লেখা। আর সেটা হবে না।

তখন গরমের ছুটি। পশ্চিমবঙ্গের এক নামীদামী কলেজে ১১ ক্লাসে অঙ্কে সদ্য ফেল করেছি। অঙ্কের গিঁটকিরি খোলার জন্য স্ব-আরোপিত বন্দিদশা চালাচ্ছি। ছুটিতে বাড়ি না গিয়ে কলকাতায় মাসীর বাড়িতে থেকে টিউশনে যাচ্ছি আর অঙ্ক নিয়ে লড়ছি। মেসোমশাই অফিসের লাইব্রেরী থেকে একদিন একটা বই নিয়ে এলেন। বেশ মোটা, ওপরটা নীল রঙের প্রচ্ছদ, গঙ্গার ঘাটের ছবি, বাঁধানো চাতালে এক বাবু আর বিবি বসে আছে। অঙ্কে বোর হয়ে একদিন দুপুরে হাতের কাছে বইটা পেয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম। প্রথম পাতা থেকেই মন ফেরাতে পারলাম না। তখনো জানিনা এটা দ্বিতীয় খন্ড। কিছুটা পড়ে কি মনে হওয়ায় খেয়াল করলাম সেটা। নাহ্‌, এ বই তো প্রথম থেকে না পড়লে চলছে না। লজ্জার মাথা খেয়ে মেসোমশাইকে বলেই ফেললাম, ‘একটু ‘প্রথম আলোর’ ফার্স্ট পার্টটা এনে দিতে পারবে?’ মেসোমশাই মুঁচকি হাসলেন যেন। ভাবলেন এ ছেলের অঙ্ক শেখা হয়েছে আরকি। আর অঙ্ক! যাকে ‘প্রথম আলো’তে ধরেছে তার কিবা অঙ্ক, কিবা ফিজিক্স। বইটা পড়ি আর ভাবি, এরকমও লেখা সম্ভব! নবজাগরণ-টণ নিয়ে তো আগেও পরেছি প্রচুর। সবই ইতিহাস বই – একটু ভারী। আর এ তো গল্পকথা। এত সহজ তাহলে নবজাগরণ ব্যাপারটা? আর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে যে লোকে বলে শক্তি-সুনীলেরা রবীন্দ্রবিদ্বেষী! বরং অনেক তথাকথিত রাবীন্দ্রিকের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের আত্তীকরণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এ বেশী। বিমল মিত্রের পরই আমি ঔপন্যাসিক হিসেবে সুনীল গাঙ্গুলীকে বসিয়ে ফেললাম, আমার কাছে। এই অবাক ভালোলাগা পরে পরে আরো বাড়িয়ে দিল ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’।iএবং প্রত্যেকটা উপন্যাসই পড়তে পড়তে এটাই মনে হত, এরকমও লেখা যায়!

পরে পরে অনেক ক্ষেত্রে তার মতের সাথে আমার মত মেলেনি। কিন্তু সেসবের সাথে সত্যিই কি তার লেখনীর কোনো সম্পর্ক আছে? তার লেখা তার যায়গায় আর তার মত তার যায়গায়। ভালোবেসেছি তার লেখাকে, কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তিনি নিজের জীবন নিজের মত করেই বেঁচেছেন। মতামত যা ছিল স্পষ্ট। সে তার কিছু কিছু কার্যক্রম কারো কারো ভালো লাগুক চাই না লাগুক। ধরি মাছ না ছুই পানি – এ জিনিস তার মধ্যে ছিল না। একজন সামান্য আঞ্চলিক সাহিত্যের লেখক – কিন্তু মৃত্যুকালেও তার ক্যারিশ্‌মার জোরে লাল-নীল-সবুজ সব এক হয়ে গেলো। হতে পারে তার পিছনে আছে রাজার নীতির জটিল-কুটিল অঙ্ক, কিন্তু শেষপর্যন্ত মেলালেন তো তিনি! অতএব, আমার অঙ্কের সাধনা গুলিয়ে দেওয়া হে কাকাবাবু, আদতে কিন্তু আপনি হারেননি, কাকাবাবু যে হারতে পারেন না।।

উৎসঃ গুগ্‌ল ইমেজেস্‌।

পুনশ্চঃ ছোটবেলার অপর শিহরণসৃষ্টিকারী কবিতাটি ছিল – ‘প্রিয়তমাসু’ – শ্রী সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা।

2 thoughts on “কাকাবাবু হেরে গেলেন।।

  1. আমার ক্লাস ফোরে বা ফাইভে পাড়ার লাইব্রেরী থেকে নিয়ে পড়েছিলাম নীললোহিতের তিন সমুদ্র সাতাশ নদী.।
    আর অনেক বড় হয়ে গল্প পলাতক ও অনুসরণকারী। আমার প্রিয় এই দুটি রচনার নাম যোগ করে দিলাম তোর লেখার সঙ্গে..

    • ধন্যবাদ অনির্বাণ। পলাতক ও অনুসরণকারী আমারও এক প্রিয় গল্প। নীললোহিতের তিন সমুদ্র সাতাশ নদীটা পড়া হয়নি। পড়ে ফেলতে হবে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s