ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হওয়াটাই তো জগতের নিয়ম। এই সেদিনের সব কচি কচি ছেলেপুলে কিরকম গটগটিয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে দেখতে বেশ লাগে। তবে বড় হওয়ার পর অন্তত নিজের ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, ধুস্ বড় না হলেই হত। বড় হওয়া মানে আরো মেকি হওয়া। বড় হওয়ার এই পাপবিদ্ধ অনুভূতিটা থেকে একটু রেহাই মেলে কয়েকটা জিনিসে। যেমন শচীন তেন্ডুলকর, রোনাল্ডো (ব্রাজিলের), সুমন বা নচিকেতা। কিরকম? এই যেমন শচীন সাদা পোশাকে হাঁটু মুড়ে একটা কভার ড্রাইভ মেরে যখন নিজেই অ্যাপ্রিশিয়েট করে তখন আজও সেই ছোটবেলার আনন্দটা খুঁজে পাই। বা যখন বড় হতে হতে হাঁপিয়ে যাই, সেই মুহূর্তে যদি কোনভাবে ‘লাল ফিতে সাদা মোজা’ বা ‘এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু’ কানে আসে, বয়সটা ঝট করে একটু কমে যায়। শচীন যেদিন পুরোপুরি অবসর নেবে আমি শিওর আমার মধ্যে ধুকধুক করে টিকে থাকা স্বল্পপরিমান শৈশবটুকুও আমায় নিদারুন ভাবে টা-টা করবে। যেমনভাবে আমি অনেকটা খুইয়েছি, যেদিন থেকে সুমন বা নচি রাজনীতি করতে গেলেন। এতো সেই ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ খ্যাত প্রতিবাদী ভাবমূর্তি-ওয়ালা কালচারক্লিষ্ট প্রমোদ প্রধান হয়ে গেল ভাই। যাকগে যাক, আসল কথায় আসি। আমার ছোটবেলার আর এক সঙ্গী, ছোটলাইন হঠাৎ করে বড় হতে লেগেছে। না মানে, ঠিক হঠাৎ করে নয়, ভূমিষ্ঠ হওয়ার ৯৬ বছর পর।
ছোট থেকেই ছোটলাইন নিয়ে কেমন একটা হীনমন্যতা কাজ করত। পিসি-মাসীর ছেলেরা যখন বড়লাইনে এমনকি ইলেকট্রিক ট্রেন এ চড়ছে আমায় তখন ছোটলাইন ধ্যাড়াতে হচ্ছে। মামার বাড়ী লাভপুর, হ্যাঁ তারাশঙ্কর বাঁড়ুজ্জে খ্যাত লাভপুরের কথাই বলছি। ভদ্রলোকের উল্লেখ থেকেই আন্দাজ করতে পারছেন বোধ হয় ম্যাকলিয়ড কোম্পানী এই লাইন পেতে এবং লাভপুরকে এর মধ্যে স্থান দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যের কি অশেষ উপকারটাই না করে গেছেন। ‘কালো যদি মন্দ তবে, কেশ পাকিলে কান্দ কেনে’ বা ‘জীবন এত ছোট কেনে’-র মত অমর লাইন সৃষ্টি হওয়ার পিছনে এই ছোটলাইনের অবদান তো কম নয়। ঠ্যাঙাড়ে-লেঠেল বংশের ছেলে নিতাই কবিয়ালের আদত পেশা কিন্তু ছিল লাভপুর ষ্টেশনের কুলিগিরি।
বাড়ি আর মামার বাড়ি যেহেতু ছোটলাইনই জুড়েছিল তাই মামার বাড়ি যেতে ছোটলাইন একটা বড় ভরসা ছিল বইকি। তার সাথে আমার ছোটবেলায় আমার আর মা-এর, দুজনেরই বাসে বমি হওয়ার একটা বদভ্যাস ছিলই। সেইজন্যও মা সবসময়ই ট্রেনটাই প্রেফার করত, আর তাই আমরাও চোখে কয়লার গুঁড়ো খেতে খেতে স্টীম ইঞ্জিনের ছোটলাইনে চড়ে বসতাম। ঘন্টায় মাত্র ১৫-২০ কিমি গতিবেগে গরুরগাড়িকেও লজ্জা দেওয়া এই ট্রেনের অতি জনপ্রিয়তার একটা মূল কারন ছিল ‘ফ্রি রাইড’।iআজ্ঞে হ্যাঁ, বিনা টিকিটে ভ্রমণ। যাত্রী সাধারনের টিকিট কাটতে যতটা আপত্তি, টিকিটবাবুরও টিকিট ঘাঁটাঘাঁটি করতে ঠিক ততটাই আপত্তি। কাজেই লোকমুখে এ হয়ে গেল ‘মামার গাড়ি’।iঅবিশ্যি গাড়ি তার ‘ভাইদের’ হলেও, মামার বাড়ি যেতে মা টিকিট কাটত না এরকমটা ভেবে বসলে কিন্তু বেজায় ভুল করবেন। একবার তো এমনও হয়েছে লাভপুর থেকে ফেরার সময়, স্টেশনমাস্টার কাম টিকিটবাবু কীর্ণাহারের টিকিট অনেকক্ষন ধরে খুঁজে না পাওয়ায় ট্রেনচালক অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারন টিকিট দিয়েটিয়ে আমাদের ট্রেনে উঠিয়ে তবে উনি পতাকা নেড়েছিলেন। মনে রাখবেন এই লাইনের কোনো ষ্টেশনই কোনদিন কম্পিউটার দেখে নি। সেই আদ্যিকালের পিচ্বোর্ডের চৌকো চৌকো টিকিট। কাজেই খুঁজে না পেলে আর কি করা, সেধে আসা হাতের লক্ষ্মী তো আর পায়ে ঠেলতে পারেন না।
![]() ছোটলাইন |
![]() বড় হচ্ছে |
এইসব পড়ে অর্থনীতিবিদরা যতই ভারতীয় রেলের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যহানি বা দেশের জি.ডি.পি. কমে-টমে যাওয়ার আশঙ্কায় চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে পড়ুন আমি কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতিতে ছোটলাইনের একটা অদ্ভুত অবদানের কথা বলব। এটা কিন্তু ঐ ষ্টেশনে চায়ের দোকান বা ট্রেনে হকারের বিক্রি বেশী এইসব ক্লিশের বাইরে – অ্যাডিশনাল। রবিদাদুর পৌষমেলা ভাঙতে না ভাঙতেই বীরভূম-বর্ধমান জুড়ে একটার পর একটা মেলা চলতেই থাকত। ‘থাকত’ কেন, এখনও ‘থাকে’।iবিক্রেতার দল মোটের ওপর কনস্ট্যান্ট থাকলেও ক্রেতারা স্থানীয়। ফুল্লরা তলা, জপেশ্বর তলা, বোরীগ তলা (বৈরাগী তলা) এরকম হাজারো সব মেলা। এদের মধ্যে বেশ কিছু মেলা বসে রেললাইনের আশেপাশে। লোকজনের যাওয়া-আসার সুবিধা, এই আরকি। এদের মধ্যে জপেশ্বরতলার মেলাখানা কীর্ণাহারের সবথেকে কাছে – ষ্টেশন থেকে রেললাইন ধরে ২-২.৫ কিলোমিটার। শিবরাত্রির এই মেলার সময় পুন্যার্থীদের অবশ্য ২-২.৫ কিমি হাঁটার কষ্টটা করতে হত না। ফর্মালি কোনো ষ্টেশন না থাকলেও ড্রাইভার সাহেব ট্রেনটিকে সেখানে দাঁড় করিয়ে পূন্যার্থীদের ওঠানামা শেষ হলে তবেই পরের ষ্টেশনের দিকে রওনা দিতেন। এখন আপনিই বলুন এই সুবিধাটুকু হওয়াতে মেলার জিলিপি, পাপড়ভাজা, প্লাস্টিকের পুতুল আর কাঁচের চুড়ির বিক্রি কি একটু হলেও বাড়ত না?
ছোটবেলায় মা-কাকীমার হাত ধরে মেলায় গেলেও একটু লায়েক হতেই ট্রেন ছেড়ে বন্ধুদের সাথে হেঁটে মেলা যাওয়াটাই দস্তুর হল। এইবেলা একটা কথা বলে রাখি। আমি ‘জপেশ্বর’ তলা বলছি বটে তবে লোকমুখে কিন্তু জায়গাটা ‘জম্পেশ্বর’ তলা নামেই বেশী পরিচিত। গ্রামাটিক্যালি ভুল হলেও ‘জম্পেশ্বর’-এর মধ্যে গ্রাম্ভারি ভাবটা বেশি থাকার দরুনই হবে হয়ত, ভোলেবাবার থানটির এই নামটিই বেশী প্রচলিত। সে যাই হোক, হেঁটে যেতে হলেও রেললাইন ধরেই যেতে হত। এবং এইখানেই ছিল সেই ভয়ের ব্যাপার। কি সেটা? একটা সাঁকো! মাটি থেকে ফুট পনেরো উঁচু আর গোটাগুটি ফুট কুড়ি লম্বা। আয়হীন এই পথে সাঁকো-টাঁকো বিশেষ সুবিধার হত না। মানসচক্ষে রেলসেতুর ছবি কিছু এসে থাকলে সেখান থেকে প্রথমেই রেললাইনের মধ্যের পাথরগুলো সরিয়ে দিন। এই রেলের লাইনে পাথর থাকার বদনাম কেউ কোনদিন দেয়নি। রেলিং-টেলিং তো দূর অস্ত। এবার রেল সাঁকোর সিমেন্টের বেসটা কল্পনা থেকে হটিয়ে দিন। শুধু দুটো লোহার গার্ডারের ওপর রেললাইনদুটো বসানো আর তাদের ধরে আছে কিছু স্লিপার। এবার আপনি সাঁকোর ওপর উঠুন। কয়েক পা স্লিপারের ওপর চলুন। নিচে তাকান। কি দেখলেন? পনেরো ফুট নিচে হয় জলকাদা না হয় শুকনো মাটি। আপনি কি করতেন জানিনা আমি যা করতাম সেটা হল বাবা ‘জম্পেশ্বরের’ নাম করে ঐ কয়েকটা স্টেপ পিছিয়ে এসে, নিচে নেমে শুকনো মাটি বা জলকাদা পেরিয়ে ওপারে গিয়ে আবার উঠে পড়া। তলা দিয়ে যেতে যেতে অবশ্যই সাহসী বন্ধুদের টিটকিরিটা সহ্য করতে হত। বড়লাইন হলে এই সাঁকোটা হয়ত অভিজাত হয়ে যাবে, সিমেন্ট আর পাথরের আস্তরনে ঢাকা পরবে ফাঁকগুলো। আর আমার চোখ তখন খুঁজে বেড়াবে মাথা-নিচু আর কান বন্ধ করে সেতুর তলা দিয়ে সেতু পেরোতে চাওয়া সেই ভীতু ছেলেটাকে।
আমার এইরকম অনেক ছোট ছোট বড় হওয়ার সাক্ষী এই ছোটলাইন। বাবা-মা-কাকা-দাদা ছাড়া গোটাগুটি একদম একা কীর্ণাহারের বাইরে যাওয়া এই ছোটলাইনে চড়েই। ক্লাশ সিক্সের হাফ্প্যান্ট পড়া, কদমছাঁট চুলের একটা ছেলেকে তার মা ছেড়েছিল ১০ কিমি দূরে টিউশনি যাওয়ার জন্য, তা সে এই ছোটলাইনেরই ভরসায়। সেখানেই একদিন সে অবাক চোখে দেখেছিল অতি পরিচিত শান্ত, সুশীল পাড়ার দাদাটিকে ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাতে। সে নিজেও কি আর এক-আধটা … বড় হওয়ার এই ছোট্ট সাথীটির বড় হতে একটু বেশীই সময় লেগে গেলো এই যা।

পুরানো সেই দিনের কথা।
(উৎস/সৌজন্যে – সমিত রায়চৌধুরী)
Abir ..Boss, khub bhao laglo pore..ekdom simple kintu khub touchy … chotobelar kotha mone porle / sunle kar na bhalo lage.. khub bhalo laglo pore.. erokom lekh aro anek..
Sugata
আরে সুগত ভায়া, ধন্যবাদ ধন্যবাদ। ছোটবেলা যে একটা ম্যাজিক্যাল টাইম, এই ব্যাপারে আমার কোনও দ্বিমত নেই।
আহা! চাপ নাও ক্যানে? মন কি আর লাইনে চলে? লাইন ছোট না থাকলে কি হল- মনের কিছুটা ছোট থাকলেই হবে (পুরোটা থাকলে আবার লোকে পাগল বলে- ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা)
লেখাটা খাসা হয়েছে- এইসব লিখবি আর ‘কথা’র জন্য লেখা চাইলেই অজুহাত দিবি, তাই তো? (রোষকষায়িত দৃষ্টি)
হাহা … রাগ করিস নে ভাই। নেক্সট লেখাটা ‘কথা’-ই পাবে কথা দিলাম। ডেডলাইন রাখিস না কোনও, এই যা। দেখছিসই তো লেখার যা রেট, ডেডলাইন রাখলে মিস হয়ে যেতে পারে।
bhison sundor lekha ta Abir….nijer chotobelar kichu smirithi romonthon kora hoye galo….wonderful…..
ধন্যবাদ ইন্দ্রদা। মানুষ যে কেন সারাজীবন ছোট হয়ে থাকে না কে জানে। ধুস্ …
tui engg. pore ato sahittic ki kore holi?amar mon chhue galo.khub bhalo laglo.tui satti genius.
এই সেরেছে, কি সব বলছ মামিমা। ‘জিনিয়াস-টিনিয়াস’ বললে কোথায় দাঁড়াই বলো দেখি! তবে লেখাটা তোমার ভালো লেগেছে দেখে খুব খুব আনন্দ পেলাম।
asadharon hoeche abirda…porte porte mon ta bes bhalo hoe jay…kintu ses dike kamon chokhe jal chole ase
অনিন্দ্য (থুড়ি মাটি), চোখে জল-টল এলে পড়িস না আর 🙂 ।
জোকস্ অ্যাপার্ট, তোর ভালো লেগেছে জেনে খুব আনন্দ পেলাম। তুই তো ঘরের ছেলে, কিছু সাজেশনস্ ও চাই কিন্তু।
বেশ ভাল হইছে। আপনার লেখার হাত আছে বটে। 🙂
আরে ধন্যবাদ ধন্যবাদ হাসান ভাই। ঐ একটু চেষ্টা-চরিত্তির করছি আরকি।
khub bhalo laglo re abir…konodin chhotoline dekhini, gram-bangla ba mafoswal o khub kom-e dekhechi….tao jyano chhobi-ta spoashto dekhte pa66ilam..!
থ্যাঙ্কু ভাই। ছোটলাইনটা আর বোধ হয় চড়ার সুযোগ পাবি না, জানি না ভারতবর্ষে আর কোথাও এখনো চলে কিনা, পশ্চিমবঙ্গে যে চলে না সেটা জানি। দার্জিলিং এর টয়ট্রেনেরও তো তথৈবচ অবস্থা। তবে গ্রাম বাংলা দেখার চান্স এখনো আছে। চলে আয় আমাদের বাড়ি। আশেপাশে যেটুকু গ্রাম বাংলা বেঁচে আছে সেগুলোর সাথে আলাপ করিয়ে দিতে পারব। আর আমারও দেখা হবে, নাগরিক হতে হতে তো গ্রামবাংলা থেকে আমিও বেশ দূরে সরে গেছি।