
উৎসঃ ইন্টারনেট
পুরাকালে পুরুষোত্তম রাম, রাবণ মারতে দুগ্গা ঠাকরুণের ঘুম ভাঙিয়েছিলেন। আমেরিকা নিবাসী বঙ্গপুঙ্গবেরা একেবারে পুরুষোত্তম না হন, কাছাকাছি তো! তাই ‘পুজো করার’ উদ্দেশ্যে অকালবোধনেরও অকালবোধন ঘটিয়ে থাকেন। এ ঐ পর্বতের মহম্মদের কাছে আগমণ আর কি। সে হপ্তার মধ্যে মা যতই এসে চলেও যান, অফিস-কাছারি, স্কুল-কলেজ শিকেয় তুলে তো আর মা-র আরাধনা হয় না। সে মা-ও জানেন। আর তাই সপ্তাহান্তে প্রবাসী বাঙালী আয়োজন করে মিনি- পুজোর।
এরকমই এক পুজোর আবহে, আমার চোখে, এদেশ ও সেদেশ (নাকি শুধুই দেশ) এর পুজোর একটা পাঁচালী আমি লিখতে বসেছি। আমার সেদেশের পুজোটা আবার ঝাঁ চকচকে আলো, প্যান্ডেল আর এগ্রোল-চাউমিনের জোরে সারারাত পুজো পরিক্রমা একেবারেই নয়। রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ-পূর্ব বীরভূমের এই শান্ত জনপদটিতে যেকোনো পুজো-পার্বন ছিল সত্যি সত্যিই ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’র সাথে নিবিড় আলাপচারিতা। যেখানে মা এর সাথে গ্রামের বাইরে থাকা ছেলেমেয়েরাও একটু জিরোতে আসে। কেরিয়ারের স্বার্থে এগারো ক্লাশ থেকে কলকাতা নিবাসী হলেও পুজোটা কোনদিনই কলকাতায় দেখিনি। ছাত্রাবস্থায় ক্লাশটেস্ট ইত্যাদির ঝামেলা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাঙ্গ করে দ্বিতীয়া বা তৃতীয়া তেই বাড়ি। ক্ষুদ্র চাকরী জীবনে অতটা নির্লজ্জ চাইলেও হতে পারিনি, অগত্যা সপ্তমীর সকাল। আরো ছোটতে অবশ্য ঠিক কবে আমার পুজো শুরু হত, হিসেব কষে বলা খুব মুশকিল। সেটা রথের দিন মূর্তি তৈরী শুরু থেকেও হতে পারে, মহালয়ার আধভাঙ্গা ঘুমে বীরেনবাবুর গলায় ‘যা দেবী সর্বভূতেষু …’ শুনেও হতে পারে, বা পঞ্চমীর সকালে সিংহের থাবায় রক্ত থুড়ি লাল রঙের শেষ পোঁচ লাগানোর সময়টাও হতে পারে। মোদ্দা কথা, পুজো আসা না আসা নিয়ে অত চাপ ছিল না। যেমন ভাবে গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা এসে শেষ হয়ে গেল, হাফ্ইয়ারলিও শুরু হয়ে শেষ হয়ে গেলো, পুজো – সেও আসবে ঠিক। মূর্তি গড়ার ব্যাপারটাতেও ছিল একটা বনেদী আলস্য। যদিও বারোয়ারী পুজোর সংখ্যা ও জাঁকজমক অনেককালই বাড়ির পুজোগুলোর থেকে বেশী, এই একটা ব্যাপারে তাদের মধ্যে বেশ মিল। মূর্তি গড়া হত হয় মণ্ডপে, না হয় একদম কাছে কোনও আটচালাতে। আর তা দেখতে পাঠশালার ছাত্রদের অবস্থা যা হত, সেটা বলা আছে সনৎ সিংহের গানে – ‘মন বসে কি আর?… না না না, তাক তা ধিনা, তাক তা ধিনা, তাক কুড়কুড়, কুড়ুর কুড়ুর তাক’৷ কলকাতায় দেবী সাধারনত ট্রাকবাহিত হয়ে কুমোরটুলি থেকে যান মণ্ডপে আর মার্কিন দেশে দেবীর আক্ষরিক অর্থেই নৌকায় আগমন – অর্থাৎ কিনা, মহাসমুদ্র পেরিয়ে জাহাজবাহিত হয়ে পা দেন স্যাম চাচার দেশে। এই জার্নির ধকল সহ্য করার জন্য মা মৃন্ময়ী নন, আরো রোবাস্ট কিছু যেমন ফাইবার গ্লাস বা শোলার। গীতায় বর্ণিত ‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি, নৈনং দহতি পাবকঃ’ … পুরোদস্তুর না হলেও ছোটখাটো দুর্বিপাক সহ্য করার ক্ষমতা এ মূর্তির থাকে।
মূর্তি তো এসে গেল। এবার তার পুজোর জায়গা খোঁজার পালা। বাড়ির পাশের মাঠে বা রাস্তা আঁটকে বাঁশ (বা মাটির ভাঁড়) এর প্যান্ডেল খাড়া করে পুজো তো আর সম্ভব নয়। তাই ডলার গুনে চার্চ, স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান হল ভাড়া করতে হয়। এগুলোর ভাড়াই সবথেকে কম। অবশ্য সে ব্যবস্থা করতে গিয়েই যদি ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয় তাহলে একটু বড় মাপের বাড়ির গ্যারাজেও পুজো হতে পারে। ভক্তি বা আনন্দের অবশ্য কোথাওই কমতি পড়ে না। আনন্দ সবথেকে বেশী করে যথারীতি বাচ্চা বা কচিকাঁচারা। অনভ্যস্ত দেশীয় জামাকাপড়ে মানিয়ে নিতেই একটু যা সময় লাগে। তারপরই শুরু করে দেয় দাপাদাপি। সবথেকে মারাত্মক হলো, হঠাৎ করে সবাই মিলে – লেটস্ রান – বলে এদিক সেদিক দৌড়নো শুরু করা। সেক্রেটারী কাকুকে ডজ্ করে, মিত্র কাকীমাকে সাইডে রেখে যেই একটু উসেইন বোল্ট স্টাইলে পিছন ফিরে অন্যদের অবস্থাটা পর্যালোচনা করতে গেছে – দুম্। লাগলো ধাক্কা সান্যাল জেঠুর সঙ্গে। সে তো উঠে-টুঠে গা ঝেড়ে আবার শুরু করতে যাবে, এমন সময় মঞ্চে আবির্ভূত হন তার রাশভারী বাবা। একটু চাপা শাসন – “বিল্টু, ডোন্ট রান লাইক দিস্। পড়ে গেলে কিন্তু লেগে যাবে।” বিল্টু একটু নতমস্তকে শুনে নেয় কথাগুলো আর তার বাবা ফের ছেড়ে আসা আড্ডায় ফিরতে না ফিরতেই সে-ও শুরু করে দেয় নতুন দৌড়।
হ্যাঁ, আড্ডা। যদিও সত্যজিৎ বাবু ‘আগন্তুক’ সিনেমায় রবি ঘোষ কে দিয়ে বলিয়েছেন, “রবীন্দ্রনাথ তো আড্ডা দেন্নি”, তবু বাঙালীকে আড্ডাহীন করা মানে যে বেজায় গাড্ডায় ফেলা, সে পাঠকমাত্রেই স্বীকার করবেন। আড্ডার চরিত্র থেকে অংশগ্রহণকারীদের সম্বন্ধে কিরকম ধারনা করা যায় দেখুন। আড্ডার টপিক গ্রীণকার্ড, H1B, ভিসা, অনসাইট, টেনিওর এইসব হলে বুঝতে হবে আড্ডার পাত্রপাত্রীরা এদেশে চাকুরীরত/রতা বা পোস্টডক বা অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর বা অনসাইটে আসা সফটওয়্যার প্রফেশনাল। গড়িয়াহাট, শাড়ি, ছেলেটা এত দুষ্টু হয়েছে ইত্যাদি – উপরিউক্তজনেদের স্ত্রী বা উপরিউক্ত পেশাস্থিত মহিলা বা দুটোই। একটু গম্ভীর, একটু উৎকণ্ঠিত, পুরোনো কারো সাথে দেখা হলে কাষ্ঠ হাসি – বুঝতে হবে ইনি পি.এইচ.ডি. র শেষদিকের ছাত্র বা ছাত্রী। পাটভাঙ্গা পাঞ্জাবী বা শাড়ি পরিহিত ইতি-উতি চাউনি, চোখেমুখে প্রবল উৎকণ্ঠা – সদ্য আগত পড়ুয়া। একটু কেয়ারলেস্ ভাবে ব্যস্তসমস্ত – বছর দুয়েকের পুরনো পাপী। এইরকম আর কি। এবার বরং আড্ডা ছেড়ে মূল পুজোয় ঢোকা যাক।
মূল পুজোর দায়িত্বে থাকেন একজন পুরোহিত। এই হট্টমেলার আসরে সবথেকে বেকায়দায় বোধহয় তিনিই পড়েন। নিজ কর্মক্ষেত্রে তিনি হয়ত একজন কৃতী। কিন্তু দেশটা পৈতেপরা পুরুত ঠাকুরের না হওয়ায় তিনিই এখন এ পুজোর মেক্শিফট পুরোহিত। এমনিতে যে জায়গায় তার নিত্য ওঠাবসা সেখানে পান থেকে চুন খসে না। আর এখানে পান পেলেন তো চুন পেলেন না! তবে পাওয়া এখানে সবই যায় – মাটির ঘট, কচি ডাব, সিঁদুর, কর্পূর মায় কৌটোয় ভরা গঙ্গাজল অব্দি। তবে এ পুরুত মশাই তো আর আদতে পুরুতমশাই নন, তাই অত জিনিসের মাঝে একটু আতান্তরে পড়ে যান আরকি। তা যা-ই হোক, পুজো কিন্তু উনি ভালোই উতরে দেন। এমনকি সন্ধি পুজোও ঠিক ২৪ মিনিটেই শেষ হয়ে যায়। তবে কিনা এটা যাকে বলে একটু থ্যাঙ্কলেস্ জব। নাহ্, ধন্যবাদ উনি প্রচুর পান (এদেশে তো লোকে উঠতে বসতে ধন্যবাদ দেয় – সেকথা আলাদা)।iকিন্তু দ-ক্ষি-ণা? সে এক মহাকষ্টের আখ্যান। ডলারেই পান উনি দক্ষিণা, কিন্তু সবটাই জমা হয় পুজোর ফান্ডে।
বাঙালির পুজো আর খাওয়া-দাওয়ার তোড়জোড় থাকবে না তা কি হয়? এখানটাতেও বাঙালি ব্যাপারটার বাঙালিকরণ করে ফেলেছে। শহুরে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স নিবাসী বাঙালি পুজোর সময় রান্নাঘরমুখো হয়না। হয় প্যান্ডেলের ধারের অস্থায়ী রান্নাঘর থেকেই খাবার আসে আর না হলে রাস্তার ধারের স্থায়ী রোলের দোকান থেকে উড়ে যায় রোল-চাউমিন। গ্রামগঞ্জে ব্যাপারটা এখনো সেরকম নয়। পুজো বলেই বাইরে খাওয়া – এই ব্যাপারটা এখনো সেরকম জমেনি। আর তাতে করে মা-কাকিমাদের কষ্ট বাড়ে বই কমে না। নির্ঘন্ট অনুয়ারী মায়ের পুজোর জোগাড় করার সাথে সাথে পরিবারের মুখে ভালোমন্দ তুলে দেওয়াটা যে বছরের পর বছর তারা করে যেতে পারেন সে বোধ হয় এই দুগ্গা ঠাকরুণেরই কৃপায়। প্রবাসে এ দুইয়ের মাঝামাঝি একটা পন্থা অবলম্বন করা হয়। এখানে তো আর রাস্তার ধারে রোলের দোকান নেই, আর প্রতিমার পাশে হাঁউমাঁউ আগুন জ্বালিয়ে রান্না করারও অনুমতি নেই। তাই নামকরা বাংলাদেশী দোকান বা কোন বাঙালিরই চালু করা ছোটখাটো কেটারিং ব্যাবসা থেকে খাবার আনানো হয়। আর পরিবেশনের দায়িত্ব কোমর বেঁধে নেয় সব্বাই মিলে। রাস্তার ধারের রোল-ফুচকার অভাব পূরণ করার চেষ্টাও থাকে কোথাও কোথাও। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের অপটু হাতে ফুচকা বা রোল বানিয়ে স্টল দেয়। আর নস্টালজিক বাঙালি তার গাঁটের ডলার খরচ করে হাপুস্-হুপুস শব্দে পুজোপ্রাঙ্গন ভরিয়ে তোলে।
দুদিনের পুজো এই করেই শেষের দিকে চলে আসে। বুঝতেই পারছেন এতো কাঠখড় পুড়িয়ে আনা মূর্তি জলে যায়না। সে যায় আবার গ্যারাজ বন্দি হতে। ভাসানের নাচের সুযোগ না থাক, ধুনুচি নাচ বা সিঁদুর খেলা কিন্তু বাদ যায়না। উঠোন বাঁকা বললেও রেহাই নাই কারও। নাচতে একটু হবেই।
পুজো শেষ। বিজয়াও হয়। দেশের মতো বাড়ি বাড়ি ঘুরে পেট আইঢাই করা ঘুঘ্নি আর নারকোল নাড়ু সাবড়ে হয়না হয়তো, তবু হয়। যে যার দৈনন্দিন কাজকর্মে ফিরে যাওয়ার আগে পুজো মণ্ডপেই ছোটরা বড়দের প্রণাম করে, বড়রা ছোটদের আশীর্বাদ করেন আর সমবয়সীরা করে কোলাকুলি। মা দুগ্গাও কৈলাশের পথ ধরেন, আর তাঁর সেবকরাও এই বিদেশ-বিভুঁয়ে একটু মন খারাপ আর এক বছরের অপেক্ষা বুকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরে।

উৎসঃ ইন্টারনেট
bah, pore khub bhalo laglo Abir. koto rokomer pujo tumi ek jibone dekhle bolo? seta ekta hingse korar motoi byapar kintu.
ঠিক কথা দি। হিংসে করো নাকো। পুজো হয়ত বেশ কিছু দেখলাম তবে, আমার তো ঐ নিজের পাড়ার পুজোটায় পৌঁছতেই সবথেকে বেশী ইচ্ছে করে।
bes bhaloi hoyechhe lekhata…
Dhonyobad Mado. Bakigulo o dekh….