মনখারাপের সাতকাহন

মনখারাপের নানা প্রকারভেদ যুগে যুগে, দেশে দেশে কবি, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী ও মাতালেরা অনেক দিয়েছেন। আমি জানিনা আমি যেভাবে ভাবনাটা ভাগ করতে চলেছি সেটা তাদের কারোও সাথে মিলে যাবে কিনা। গেলেও ক্ষতি কিছু নেই। একটু না হয় মনখারাপই করে নেবেন ওঁরা।

আমার কাছে মনখারাপ দুইরকম – একপ্রকারে আপনার চোখে জল আসবে, সকলকে লুকিয়ে দু-এক পশলা কেঁদেও নেবেন আপনি। দ্বিতীয়টাতে কান্নাটা আসি আসি করেও আসবে না। গলার কাছটা দলা পাকিয়ে থাকবে। প্রথমটা আমার জীবনে এসেছে, বেশ কয়েকবার এসেছে। এই যেমন ‘তারে জমিন পর’ বা ‘দ্য বয় ইন দ্য স্ট্রাইপ্‌ড পাজামাস্‌’ সিনেমাটা শেষ হল যখন। অথবা ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ তে মা-খেগো বলরাম বা ‘লোটাকম্বল’-এ পলাশের এর মাতামহের মারা যাওয়ার বর্ণনাটা। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে পড়েছিল। তবে আজ আমি দ্বিতীয় রকমটাই আপনাদের সাথে ভাগ করে নেব। দেখি গলার দলাটা একটু যদি হালকা হয়।

মেঘপিয়নের ব্যাগের ভিতর মন খারাপের দিস্তা/মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা
খুব কচিবেলার যে ঘটনাটার কথা আমার মনে আছে সেটা আমার ৯ কিলোমিটার দূরের মামাবাড়িতে। মামাবাড়ি ভারি মজা কিল চড় নাই, সে তো ঠিক আছে। কিন্তু সেদিন যে আমার পিসতুতো দাদা তার মামাবাড়ি অর্থাৎ আমাদের বাড়ি আসছে। সেই পিসতুতো দাদা, যে যদিও থাকে বর্ধমানে, আমার মনে হত অন্য গ্রহের মানুষ। তা হবে না? বর্ধমানে বড়লাইনের ট্রেন চলে, দাদাটি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, শুধু পড়ে না বছর বছর ফার্স্ট হয় আর কাঁড়ি কাঁড়ি প্রাইজ পায়, নিজেদের গাড়ী চড়ে, বাড়িতে ভি.সি.আর. আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তা সে আসছে, আর আমি মামাবাড়িতে পড়ে। খুড়তুতো দাদা আর ভাই মিলে সবটা পেয়ে যাবে তার। এ কি সহ্য হয়। তাই সকাল থেকে মন মেঘলা। মা কিছু বুঝতে পারে, মা-রা সবসময়ই পারে সে আর নতুন কথা কি! বলেই ফেললাম মনোকষ্টের কারন। মা তার ভাইদের বলে ব্যবস্থা করল আর আমরা ফিরলাম বাড়ি। পিসতুতো দাদাকে বোধহয় একঘন্টার বেশী খুড়তুতো দাদা-ভাইদের হাতে ছাড়তে হয়নি।

লাল খেরোর খাতা

উৎসঃ ইন্টারনেট।

সরস্বতী বিদ্যেবতী, তোমায় দিলাম খোলা চিঠি/ একটু দয়া করো মা গো বুদ্ধি যেন হয়
এরপরের ঘটনাটাতেও মা একটা মুখ্য চরিত্র। সিক্সে উঠেছি, গরমের ছুটি। আমাদের পারিবারিক মাস্টারমশাই অঙ্ক করাতে ভালোবাসতেন আর আমিও বছরের শুরুতে টাটকা অঙ্কে মন দিতাম বেশী। সেবছর লাল শালুর মলাট দেওয়া বাবার পুরোনো হিসেবের খাতায় হচ্ছে অঙ্ক। খাতার পাতাগুলো এত ভাল আর সাদা হত যে নিজেই চেয়ে নিয়েছিলাম একখানা পুরোনো খাতা। ১৭ কি ১৮ তম অনুশীলনী তে ছিল সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্ক। নতুন সিড়ি ভাঙ্গতেও শিখে গেলাম, সে কি উত্তেজনা। একদিন সন্ধেবেলা দেখি খাতাখানা খুঁজে পাচ্ছি না। উথালপাতাল খুঁজলাম তাও পাচ্ছি না। অগত্যা মায়ের শরণাপন্ন। মাও প্রথমে এর আগের অনেক জিনিসের মত খুঁজে পেয়ে যাবে বলে আমাকে একটু বকাবকি করলো। সে আমি গায়ে মাখলাম না – কুছ পানে কে লিয়ে ডাঁট খানা পড়তা হ্যায়। কিন্তু খাতার বিবরণ শুনে দেখি মায়ের মুখটা একটু কেঁপে গেল। প্রথমে আমিও পাত্তা দিইনি। আস্তে আস্তে দেখলাম আমি মিথ্যে বললে মা যেমন বুঝতে পারে, তেমন করে আমিও আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি ডালমে কুছ কালা হ্যায়। শেষমেশ যা বুঝতে পারলাম, মা না বুঝতে পেরে পুরোনো খাতা ভেবে ফেলে দিয়েছে। বেজায় কষ্ট পেয়েছিলাম। মা অনেক করে বুঝিয়েছিল যে অঙ্কগুলো আবার করলে ভাল বই মন্দ হবে না। কিন্তু মা কি করে বুঝবে প্রথম বারের উত্তেজনা আর ফিরবে না।

শচীন

উৎসঃ ইন্টারনেট।

খেলছে শচীন খেলছে শচীন মারছে শচীন ছয়/ খেলছে শচীন খেলছে শচীন মারছে শচীন চার
পরের ঘটনাটা আর একটু বড় হয়ে। এইট বা নাইন এ পড়ি। বহুদিন পর পাকিস্তান এসেছে টেস্ট খেলতে ভারতে। এবং সে এখনকার পুতুপুতু পাকিস্তান নয়, রীতিমত ওয়াসিম, ওয়াকার, শোয়েবের গনগনে আঁচ। চেন্নাইতে খেলা হচ্ছে। হেরে যাওয়া ম্যাচ পিঠের অসহ্য ব্যথা উপেক্ষা করেও ভগবান তার নিজের মহিমায় প্রায় জিতিয়ে দিচ্ছিলেন। বাড়ির সবাই একতলায় সাদাকালো টি.ভি. তে চোখ ঠেকিয়ে। আমি কুসংস্কার বশতঃ দোতলায় রেডিও কানে। শেষবেলায় ভগবান আর পারছিলেন না, মেরে আউট হয়ে গেলেন। মাত্র ১৭ রান দূরে জয় দেখা যাচ্ছে, হাতে তখনো তিন-তিনটে উইকেট। আর কুম্বলে, শ্রীনাথরা বড়লোকের বাউন্ডুলে ছেলের মত ৪ রানের মধ্যে সব আউট। কষ্টটা দলা পাকিয়েছিল অনেকক্ষণ, ভাবছিলাম ভগবান কি ভাবছেন। আজ রাত্তিরে খেতে পারবেন? মাঠে খেলতে গিয়েও খেললাম না দেখে বন্ধুরা যখন জিজ্ঞাসা করল কারণ কি, বললাম ‘মন ভালো নেই’।

মন রে কৃষিকাজ জানো না
পরের ঘটনা কলকাতার উপকন্ঠে মিশনের আবাসিক কলেজে। একটা বেশ কঠিন সাবজেক্টের পরীক্ষা চলছে। সাবজেক্টটি ছিল আই.সি. (Indian Culture) – ১৬-১৭ বছরের পক্ষে বেশ কঠিন কঠিন কনসেপ্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন খোদ প্রিন্সিপাল মহারাজ। আসলে তখন সবে সবে মিশনের পরিমণ্ডলে এসেছি। ছিলাম কুঁয়োর ব্যাঙ, আর সেখান থেকে সরাসরি স্বামীজির মানুষ গড়ার কারখানায়। মানুষ – অতি সাধারণ মানুষই যে দেবতা সেই কথাটাই তখন নতুন শুনছি। তার আত্তীকরন, প্রতিবাদ, যুক্তি-প্রতিযুক্তি তখন বহুদূর। সারভাইভ করতে হবে। নিজেকে নিয়ে সযত্নে গড়ে তোলা মুগ্ধতার আবরণ যখন খসে পড়েছে, তখন নিজেকে বাঁচাতে শরণ নিলাম অসাধুতার। মিশনে ছোট থেকে পড়াশুনো করা নরম মনের বন্ধুটিকে রাজি করালাম, ‘ভাই পরীক্ষাটায় একটু উৎরে দিবি?’ আমার মুখ দেখে করুণা হওয়ায় সে রাজি হল। বন্দোবস্ত হল, সে লিখে তার পাশে রেখে দেবে, আমি পিছনের বেঞ্চ থেকে পাশমার্কটুকু তুলে নেব। কিন্তু বিধি বাম। সেই ঘরের গার্ডকে আড়াল করে লিখছিলামও (আই মিন টুকছিলাম)। শমন যে পাশের ঘরে ওত পেতে আছে, তা কেই বা জানত। পাশের ঘরের গার্ড ফেললেন ধরে। সঙ্গে সঙ্গে দুজনকেই পাঠানো হল মহারাজের ঘরে। যাওয়ার সময় শুধু ভাবছিলাম, শেষ পর্যন্ত আমিও! ত্যাগী ও জ্ঞানী মানুষটি শুধু একবার তাকালেন আমাদের দিকে। সর্বাঙ্গে গেরুয়া পরিহিত মানুষটির সেই মুখ আমি কখনো ভুলব না। পরিধানের গেরুয়া বর্ণের সঙ্গে মুখের রঙের কোন পার্থক্য করা যাচ্ছিল না। রাগ বা লজ্জা যা-ই থেকে থাকুক না কেন সেই দৃষ্টিতে, তিনি শুধু বললেন, ‘যাও’। পড়ে আসা বিকেলের মধ্যে দিয়ে আমি আর সেই বন্ধুবর ফিরে এলাম হস্টেলের দিকে। বন্ধুর কাছে যথোচিত ক্ষমাপ্রার্থনার পরে, হস্টেল পেরিয়ে চলে গেলাম মাঠের দিকে। মনখারাপ করা বিকেলটা কাটলো অনেকক্ষণ ধরে । রাত্তিরে মহারাজ ডেকে পাঠালেন। জীবনে চলার কয়েকটা পাথেয় দিলেন। যখনই আবার ‘সারভাইভ’ করার মত পরিস্থিতি এসেছে, ঐ পাথেয় থেকে ঠিক ঠিক রসদ সংগ্রহ করা গেলে, দেখেছি ঠিক বেঁচে গেছি।

ও মনরে, স্বপ্ন দেইখা রইলি ভুলে/ আমার এই স্বপন কি মিথ্যা হইতে পারে রে
এর পরের ঘটনাটাও ঐ সময়েরই। ফিজিক্স টিউশনে গিয়ে দেখি এ আমাদের কীর্ণাহারের মাটিতে গোল হয়ে বসে পড়া নয়। এখানে পুরোদস্তুর বেঞ্চ-টেঞ্চ আছে, এমনকি মাইনে দেওয়ার রেজিস্টার মেইন্‌টেইন করা হয়। এখানেই সে-ও পড়ত। মাধ্যমিকে ফিজিক্সটা অ্যাডিশনাল ছিল, তাই দু-একটা অঙ্ক এগারো ক্লাশেও চেনা-পরিচিত বেড়িয়ে যেত। এরকমই একদিন দু-একটা অঙ্ক নামিয়ে ফেললাম তাড়াতাড়ি। দেখি সে পাশে বসে আছে অবাক দৃষ্টিতে। না চাইতেই, তাকেও একটু হেল্প করে দিলাম। সে শুধু বলল, ‘বাহ্‌ তুই তো বেশ সহজে বোঝাতে পারিস। তোর কাছে মাঝে সাঝে কিছু জিনিস দেখিয়ে নেব।’ মন ভাবল, ‘এ কি শুনলাম’? মন প্রশ্ন করল, আবার ‘মাঝে মাঝে’-টা কেন? মন ঠিক করল, ‘ফিজিক্সটা ঠিকঠাক পড়তে হবে। আর মুখে বললাম,’আরে সে তো অবশ্যই। আমি পারলে কেন দেখিয়ে দেব না’? কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তার পরের দিন সে আর পাশে বসল না, তার পরের দিনও না, তার পরের দিনও না। মন বলল তাতে কি হয়েছে? অঙ্ক আবার আটকাবে। তারপর একদিন দেখলাম কলেজের দোতলার বারান্দায় কাগজফুলের গাছটার পাশে, রেলিং-এ ভর দিয়ে সে দাঁড়িয়ে। লম্বা বারান্দার শেষে আমায় দেখতে পেয়ে মুখ তুলে জলভরা মেঘ ছড়ান হাসিটা হাসল। ধড়ফড় করে জেগে উঠলাম আমি হোস্টেলের সেই ৩ ফুট বাই ৭ ফুট তক্তাতে। মনটা এক ঝটকায় খারাপ হয়ে গেল। এরকম করে কি ভয় পাইয়ে দিতে আছে? স্বপ্নটা আর একটু চললে কি-ই বা ক্ষতি হত? আসলে বাস্তবে যে স্বপ্নটা ভাঙতে চাইছিল না, স্বপ্ন এসে সেই স্বপ্নের ‘দ্য এন্ড’ করে দিলো। ভাঙা মন নিয়ে বাকি রাতটুকু জেগেই কাটলো।

এখনো সামনে পথ হাঁটা বাকি/ চাইলেও দিতে পারবে না ফাঁকি
বেশ অল্পবয়সেই বাড়ির বাঁধন কেটে বের হয়ে আসাটা আমার একটা প্রচ্ছন্ন গর্বের জায়গা ছিল। আর সেই গর্বের জায়গা থেকেই ভাবতাম, যে আমি এগারো ক্লাশ থেকে বাড়ির বাইরে, তার কি আর বিদেশ যাত্রায় কিছু কষ্টের থাকতে পারে? পারে,- আর সেটা বুঝলাম একটু অদ্ভুত ভাবে। চাকরির শেষদিন আর কম-সে-কম পাঁচ বছরের জন্য বিদেশ যাওয়ার দিনের মাঝে দিন কুড়ি সময় ছিল। সেই সময়টা কাটালাম বাড়িতে। টানা কুড়ি দিন এর আগেও কাটিয়েছি বাড়িতে কিন্তু এইটা অন্যরকম। বাবা দেখি থেকে থেকে যা যা খেতে ভালোবাসি নিয়ে আসছে, সকালে অস্বাভাবিক রকম দেরী করে ঘুম থেকে উঠলেও মা কিছু বলছে না। শেষের দিনটা হঠাৎ করে যেন বুঝতে পারলাম, হুট্‌ বলতেই টুক করে চলে আসা যাবে না, এইরকম একটা জায়গায় পাড়ি জমাচ্ছি। যেই না মনে হওয়া, অমনি মন বলল ‘আমার ভালো লাগছে না’। সারা সকাল মুখের যা অবস্থা হয়েছিল, সে কহতব্য নয়। সেদিনের কিছু ছবি এখনো আছে। যদি বলেন, ‘দেখি সে ছবি’, এখন থেকেই বলে দিচ্ছি প্রাণ থাকতেও সে আমি পারব না। আমার সেই বাংলার পাঁচের মত মুখ দেখে আপনাদের মুচকি হাসি – দৃশ্যটা কল্পনা করেই আমার একটা জঘন্য রকমের ইয়ে হচ্ছে।

উনকি বাঁতো কা জরাসা ভি অসর্‌ মত্‌ লেনা/ ওয়রনা চেহ্‌রে কি তাসুড় সে সমঝ্‌ জায়েঙ্গে
পরের ঘটনাটা এই পরবাসে। তবে ঘটনার মাধ্যম আন্তর্জালিকা – স্যোশাল নেটওয়ার্ক। ছবি দেখে মুগ্ধ হলাম। আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে অঙ্ক আটকানোর অপেক্ষায় বসে থাকলে আর হবে না। শুরু করলাম ভার্চুয়াল পত্রালাপ। অবশ্য একতরফ থেকে মাসে তিনটে আর অন্য তরফ থেকে তিন মাসে একটা মেসেজ যাওয়া আসা করলে তাকে রসিকজন হয়ত পত্রালাপ নাও বলতে পারেন। তবে যে চিঠির উত্তর পেতাম বা বলা ভাল যেদিন পেতাম নিজেকে জাস্ট রাজা মনে হত। একবার লিখেছিলাম ফোন নম্বর দেওয়ার জন্য। তাতে সে বলল, ফোনে কি আসে যায়! মেনে নিলাম। মাঝখানে সাত সমুদ্রের ফারাক, তবু একটা অক্ষম চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। একদিন হঠাৎ করেই বালির বাঁধ গেলো ভেঙে। সে নিজেই জানালো সে অন্য কারো বাগদত্তা। ব্যাপারটাতে তেমন মনখারাপ হয়নি, কারন বোধহয়, ইঙ্গিতটা ছিলই। মনখারাপটা কখন হলো জানেন? যখন সে বলল (আমারই চাপাচাপিতে) যে সে অনেকদিন থেকেই জানত তার প্রতি আমার সফ্‌ট কর্ণারের কথা। তাহলে আগে বললো না কেন? মনকে বোঝালাম, মনটা যাতে ভেঙে না যায় তাই সে এতদিন কিছু বলেনি। মন দেখলাম ফুরফুরে হয়ে গেল। গেল কি?