সদ্য আমার সাইকেলখানা খোঁড়া হয়েছে। মানে দুটো চাকাই একসাথে পাংচার। কবে সারাব তার ঠিক নেই। তাই পাপী মনকে স্বান্তনা দিতে সাইকেল নিয়ে দু-কলম লিখে ফেললাম। এই পার্টিকুলার সাইকেলটা বছর দুয়েক আগে শহিদ ভাইয়ের থেকে কেনা। একখানা সাইকেলের মালিক হওয়াতে মনে আছে বেশ খুশিই হয়েছিলাম। তা একটা ধেঁড়ের একটা সাইকেল (তাও আবার সেকেন্ড হ্যান্ড) হওয়াতে এতটা উৎফুল্ল হওয়ার কি আছে? আছে আছে। সেই কবে মণীষা কৈরালাকে সামনে বসিয়ে আমির খান ‘রাজা কো রানী সে প্যার হো গ্যায়া’ গেয়েছিলেন। সেই থেকে একটা ঐরকম কেত্-এর রংচঙে সাইকেলে নিজেকে দেখার আমার চুড়ান্ত সখ।এই দেখুন সেই সাইকেল।
আসলে মার্কিন দেশে একটা বাহন নিতান্তই দরকার। এখানে তো আর সুভাষ-মদন বাবুর অটো নেই যে হাত দেখাব আর থেমে গিয়ে বলবে, ‘দাদা একটু চেপে বসে যান, আর একজন হয়ে যাবে’। আর তারপর, বাস, লরি, রিক্সা, বাইক সব্বাইকে সাইড করে, অলি-গলি-তস্যগলি বেয়ে পারলে লোকের বাড়ির উঠান দিয়েও নিয়ে গিয়ে ঠিক গন্তব্যস্থানে পোঁছে দেবে। নাহ্, সে সুখ মার্কিন সায়েবদের কপালে নেই। তেনারা গাড়ি চড়েন আর যে দুয়েকটা বাসের দেখা কালেভদ্রে মেলে তারা মোটামুটি মাছি তাড়ায়। তা এ হেন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনমতো চলাফেরা করতে হলে একখানা চারচাকাই দস্তুর, কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকায় দু-চাকাতেই মনোনিবেশ করেছিলাম আরকি।
সাইকেলের মালিকের সাথে দরাদরি ও সাইকেলের সাথে তার সেন্টিমেন্টাল সম্পর্ক নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলাপচারিতার পর সাইকেল নিয়ে চলে এলাম বাড়ি। একটু ধুয়েমুছে, নাটবল্টু টাইট দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে যেই প্যাডেলে চাপ দিয়েছি, হুশ করে পৌঁছে গেলাম, ২০ বছর পিছনে আর ৮০০০ মাইল দূরে। প্রথম সাইকেলটিও ছিল সেকেন্ডহ্যান্ড, তাও আবার ছোট ভাইয়ের সাথে ভাগাভাগি করে। সেটার আবার পিছনের চাকার দুপাশে ছোট্ট আরও দুটো চাকা। মানে যাতে কষ্ট করেও কেউ উল্টে পড়তে না পারে। সে সাইকেলে প্রাথমিক ব্যপারগুলো রপ্ত হলে বাবা-কাকাদের সাইকেলে হাফপ্যাডেল করে (ও বেশ কয়েকবার উলটে পড়ে) একটু একটু করে পাকা সাইকেল চালিয়ে হয়ে উঠলাম।
গোটাগুটি একটা সাইকেলের মালিক হতে হতে ক্লাশ সেভেন। এবং এবারও সেকেন্ডহ্যান্ড। প্রথম মালিক ছিল বড়দা। ভেবে দেখলাম, আমার জীবনে এখনো অব্দি একটা ফার্স্টহ্যান্ড সাইকেলও আমার জোটেনি। যাক সে দুঃখের কথা! টিউশন থেকে স্কুল থেকে খেলার মাঠ সর্বদা সেটিই বাহন। আর তার সাথে সদ্য বয়োঃপ্রাপ্ত কিশোরের হাতে সাইকেল! আগে থেকেই আলোকপ্রাপ্ত বন্ধুদের আহ্বানে গার্লস স্কুলের সামনে নির্দিষ্ট সময়ে দাঁড়ানোর হাতছানি। সে হাতছানিতে ঘনঘন সাড়া না দেওয়ার বোকামির জন্য এখনো হাত কামড়াই। কি এক বোকার মত ভালো ছেলের মোড়ক বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। সাইকেল চড়ে মেয়ে স্কুলের সামনে কেত মারা বা না মারার ওপরে যে ছেলের ‘ভালোত্ব’ নির্ভর করে না, সেটা আমায় জীবন বুঝিয়েছে আরও পরে।
ক্লাশ টেন অব্দি সাইকেল ব্যাপারটা অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে ছিল জীবনের সাথে। তারপর থেকে তো ঠাঁইনাড়া আর সেই ঠাঁইনাড়া ঠাঁই-য়ে সাইকেলের জায়গা কোথায়? নিজের সাইকেল হওয়ার বহু আগে থেকেই অবশ্য টিউশন ক্লাশ সেরে বাড়ি ফিরতাম সাইকেলে চড়েই। ভাবছেন সেটা কিরকম? আসলে আমাদের পারিবারিক মাস্টারমশাই আমাদের পড়ানো শেষ করে নিজের কর্মস্থলে আসতেন সাইকেলে চড়ে। আর আমার বাড়ি পথিমধ্যে হওয়ায় আমি সেই পথটুকু ওনার সাইকেলে চড়েই আসতাম। ছাত্রকে বয়ে চলার এতবড় নিদর্শন আর কোথাও পাবেন কি?
আমাদের আধা মফস্বলে একটা রীতি খুব মেনে চলা হত। ধরুন আপনি সাইকেলে চড়ে চলেছেন। এমন সময় দেখলেন আপনার স্কুলের বা টিউশনের কোনো শিক্ষক বা শিক্ষিকা সামনে। আপনি কিন্তু সাইকেলে থেকে নেমে তবে তাকে পেরোবেন। ব্যাপারটা হয়ত তেমন কিছু না, যুক্তিও না চাইলে খুঁজে পাবেন না, তবু বলতে পারেন শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে নিরন্তর বয়ে চলা শ্রদ্ধা-ভালোবাসার একটা বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সেরকমই একদিন আমাদের স্কুল যাওয়ার পথে শঙ্কুবাবুকে দেখে আমরা সবাই এক এক করে সাইকেল থেকে নেমে ওনাকে পেরিয়ে আবার সাইকেলে গিয়ে উঠে পড়ছি। পারলনা একজন। সেকথায় আসছি, তার আগে শঙ্কুবাবুর একটু বিবরণ দেওয়া যাক। শঙ্কুবাবু মানেই সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি, একমাথা সাদা চুল (মধ্যে একটু লাল আভা আর তাতে দুষ্টু ছেলেরা বলত তারা নাকি জানে, যে স্যার মাথায় নিয়ম করে জবাফুল ঘষতেন) আর হনহন করে হাঁটা। তা সেদিন আমরা সবাই নির্বিঘ্নে পেরিয়ে গেছি। হঠাৎ শুনি স্যারের গলা, “অ্যায় গান্ধী, নাম।” বন্ধুবর অনির্বাণ গান্ধী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নেমে পড়ল সাইকেলে থেকে। আমরাও থামলাম। “সাইকেলটা দে”। গান্ধী দিল। স্যার চড়লেন এবং বললেন, “নে এবার চাপ”। গান্ধী এবং আমরাও ভাবছি, “মানে”? মানেটা হল, স্যরের সেদিন একটু দেরী হয়েছে, হেঁটে গেলে প্রেয়ারের আগে পৌছতে পারবেন না। আর তাই স্যার গান্ধীর সাইকেলে চালকের আসনে আর গান্ধী রড-এ। আর সে কি সাইকেল চালনা! চোখের পলকে আমাদের সবাইকে পেরিয়ে, স্কুলটাইমের ঐ ভীড়ের মধ্যেও আক্ষরিক অর্থেই পাঁইপাঁই করে সাইকেল চালিয়ে সবার আগে স্কুলে পৌছলেন। আমরা পৌছে দেখি, মাঠের মাঝখানে সাইকেল হাতে গান্ধীবাবা দাঁড়িয়ে আর স্যার সেই হন্হনিয়ে হাঁটছেন।
সপ্তাহে তিন দিন সন্ধ্যাবেলায় পড়তে যেতাম ‘অঙ্কের জাহাজ’ নামে খ্যাত অনাদিবাবুর বাড়ি। সেখানেও বাহন সাইকেল আর এক্ষেত্রে সঙ্গী এক ক্লাশের সিনিয়র তুহিন। ওকে তুহিন’দা বলছিনা দেখেই বুঝতে পারছেন নিশ্চয় যে ছেলেটা নিছক সিনিয়র নয় বন্ধুই। যাওয়া-আসার পথে কত সুখ-দুঃখের কথা হত – যেমন কেমন করে আরো জোরে বল করা যায়, গড়াই এর আউটটা শিওর ছিল, কালকে ইংরিজী টিউশনে অমুক তুহিনের দিকে ৫ বার আড়চোখে তাকিয়েছে আর ভূগোল টিউশনে তমুক আমার দিকে বোধহয় ৩ বার ও তাকায়নি – এইসব আরকি। আর এসব কথা বেশিরভাগটা ফেরার সময়ই হত। কারন আমার মতে দুটো। প্রথমতঃ তখন রাত্তির সাড়ে ন-টা মানে প্রায় সেদিনটা শেষ আর জীবনের মত, দিনেরও শেষেই তো সুখ-দুঃখের হিসেবটা জমে বেশি। দ্বিতীয় কারনটা ছিল প্রায় নিয়ম করে লোডশেডিং। অন্ধকার রাস্তাটা এইসব অমুল্য হিসেব-নিকেশের জন্য আদর্শ। ফেরার রাস্তাটাও তাই সবসময়ই দীর্ঘতর হত। এখনো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেটাই দেখি। তুহিন ছিল আগের ক্লাশের ফার্স্টবয়। কিন্তু তার জন্য যে ভালোছেলে মার্কা মেকিপনার কোন দরকার নেই, সেটা তুহিনকে দেখেই আমার শেখার শুরু। কথায় কথায় অমলিন হাসি আর মাঝেসাঝে কাঁচা খিস্তিও যে জীবনে দরকার সেটা যখনই ভুলে যাই, এই পথটা আবার পেরোতে ইচ্ছে করে। জানি সেই লাল হিরো সাইকেলটা বাবা মাঝেমাঝেই মুছে রাখে, তেলও দেয়, এই আমিই শুধু শুধু সেখানে পৌছতে পারিনা।