সাইকেলের দুদিকে চাকা …

সদ্য আমার সাইকেলখানা খোঁড়া হয়েছে। মানে দুটো চাকাই একসাথে পাংচার। কবে সারাব তার ঠিক নেই। তাই পাপী মনকে স্বান্তনা দিতে সাইকেল নিয়ে দু-কলম লিখে ফেললাম। এই পার্টিকুলার সাইকেলটা বছর দুয়েক আগে শহিদ ভাইয়ের থেকে কেনা। একখানা সাইকেলের মালিক হওয়াতে মনে আছে বেশ খুশিই হয়েছিলাম। তা একটা ধেঁড়ের একটা সাইকেল (তাও আবার সেকেন্ড হ্যান্ড) হওয়াতে এতটা উৎফুল্ল হওয়ার কি আছে? আছে আছে। সেই কবে মণীষা কৈরালাকে সামনে বসিয়ে আমির খান ‘রাজা কো রানী সে প্যার হো গ্যায়া’ গেয়েছিলেন। সেই থেকে একটা ঐরকম কেত্‌-এর রংচঙে সাইকেলে নিজেকে দেখার আমার চুড়ান্ত সখ।এই দেখুন সেই সাইকেল।

আসলে মার্কিন দেশে একটা বাহন নিতান্তই দরকার। এখানে তো আর সুভাষ-মদন বাবুর অটো নেই যে হাত দেখাব আর থেমে গিয়ে বলবে, ‘দাদা একটু চেপে বসে যান, আর একজন হয়ে যাবে’। আর তারপর, বাস, লরি, রিক্সা, বাইক সব্বাইকে সাইড করে, অলি-গলি-তস্যগলি বেয়ে পারলে লোকের বাড়ির উঠান দিয়েও নিয়ে গিয়ে ঠিক গন্তব্যস্থানে পোঁছে দেবে। নাহ্‌, সে সুখ মার্কিন সায়েবদের কপালে নেই। তেনারা গাড়ি চড়েন আর যে দুয়েকটা বাসের দেখা কালেভদ্রে মেলে তারা মোটামুটি মাছি তাড়ায়। তা এ হেন পরিস্থিতিতে প্রয়োজনমতো চলাফেরা করতে হলে একখানা চারচাকাই দস্তুর, কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান থাকায় দু-চাকাতেই মনোনিবেশ করেছিলাম আরকি।

সাইকেলের মালিকের সাথে দরাদরি ও সাইকেলের সাথে তার সেন্টিমেন্টাল সম্পর্ক নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলাপচারিতার পর সাইকেল নিয়ে চলে এলাম বাড়ি। একটু ধুয়েমুছে, নাটবল্টু টাইট দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে যেই প্যাডেলে চাপ দিয়েছি, হুশ করে পৌঁছে গেলাম, ২০ বছর পিছনে আর ৮০০০ মাইল দূরে। প্রথম সাইকেলটিও ছিল সেকেন্ডহ্যান্ড, তাও আবার ছোট ভাইয়ের সাথে ভাগাভাগি করে। সেটার আবার পিছনের চাকার দুপাশে ছোট্ট আরও দুটো চাকা। মানে যাতে কষ্ট করেও কেউ উল্টে পড়তে না পারে। সে সাইকেলে প্রাথমিক ব্যপারগুলো রপ্ত হলে বাবা-কাকাদের সাইকেলে হাফপ্যাডেল করে (ও বেশ কয়েকবার উলটে পড়ে) একটু একটু করে পাকা সাইকেল চালিয়ে হয়ে উঠলাম।

গোটাগুটি একটা সাইকেলের মালিক হতে হতে ক্লাশ সেভেন। এবং এবারও সেকেন্ডহ্যান্ড। প্রথম মালিক ছিল বড়দা। ভেবে দেখলাম, আমার জীবনে এখনো অব্দি একটা ফার্স্টহ্যান্ড সাইকেলও আমার জোটেনি। যাক সে দুঃখের কথা! টিউশন থেকে স্কুল থেকে খেলার মাঠ সর্বদা সেটিই বাহন। আর তার সাথে সদ্য বয়োঃপ্রাপ্ত কিশোরের হাতে সাইকেল! আগে থেকেই আলোকপ্রাপ্ত বন্ধুদের আহ্বানে গার্লস স্কুলের সামনে নির্দিষ্ট সময়ে দাঁড়ানোর হাতছানি। সে হাতছানিতে ঘনঘন সাড়া না দেওয়ার বোকামির জন্য এখনো হাত কামড়াই। কি এক বোকার মত ভালো ছেলের মোড়ক বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। সাইকেল চড়ে মেয়ে স্কুলের সামনে কেত মারা বা না মারার ওপরে যে ছেলের ‘ভালোত্ব’ নির্ভর করে না, সেটা আমায় জীবন বুঝিয়েছে আরও পরে।

ক্লাশ টেন অব্দি সাইকেল ব্যাপারটা অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে ছিল জীবনের সাথে। তারপর থেকে তো ঠাঁইনাড়া আর সেই ঠাঁইনাড়া ঠাঁই-য়ে সাইকেলের জায়গা কোথায়? নিজের সাইকেল হওয়ার বহু আগে থেকেই অবশ্য টিউশন ক্লাশ সেরে বাড়ি ফিরতাম সাইকেলে চড়েই। ভাবছেন সেটা কিরকম? আসলে আমাদের পারিবারিক মাস্টারমশাই আমাদের পড়ানো শেষ করে নিজের কর্মস্থলে আসতেন সাইকেলে চড়ে। আর আমার বাড়ি পথিমধ্যে হওয়ায় আমি সেই পথটুকু ওনার সাইকেলে চড়েই আসতাম। ছাত্রকে বয়ে চলার এতবড় নিদর্শন আর কোথাও পাবেন কি?

আমাদের আধা মফস্বলে একটা রীতি খুব মেনে চলা হত। ধরুন আপনি সাইকেলে চড়ে চলেছেন। এমন সময় দেখলেন আপনার স্কুলের বা টিউশনের কোনো শিক্ষক বা শিক্ষিকা সামনে। আপনি কিন্তু সাইকেলে থেকে নেমে তবে তাকে পেরোবেন। ব্যাপারটা হয়ত তেমন কিছু না, যুক্তিও না চাইলে খুঁজে পাবেন না, তবু বলতে পারেন শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে নিরন্তর বয়ে চলা শ্রদ্ধা-ভালোবাসার একটা বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সেরকমই একদিন আমাদের স্কুল যাওয়ার পথে শঙ্কুবাবুকে দেখে আমরা সবাই এক এক করে সাইকেল থেকে নেমে ওনাকে পেরিয়ে আবার সাইকেলে গিয়ে উঠে পড়ছি। পারলনা একজন। সেকথায় আসছি, তার আগে শঙ্কুবাবুর একটু বিবরণ দেওয়া যাক। শঙ্কুবাবু মানেই সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি, একমাথা সাদা চুল (মধ্যে একটু লাল আভা আর তাতে দুষ্টু ছেলেরা বলত তারা নাকি জানে, যে স্যার মাথায় নিয়ম করে জবাফুল ঘষতেন) আর হনহন করে হাঁটা। তা সেদিন আমরা সবাই নির্বিঘ্নে পেরিয়ে গেছি। হঠাৎ শুনি স্যারের গলা, “অ্যায় গান্ধী, নাম।” বন্ধুবর অনির্বাণ গান্ধী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নেমে পড়ল সাইকেলে থেকে। আমরাও থামলাম। “সাইকেলটা দে”। গান্ধী দিল। স্যার চড়লেন এবং বললেন, “নে এবার চাপ”। গান্ধী এবং আমরাও ভাবছি, “মানে”? মানেটা হল, স্যরের সেদিন একটু দেরী হয়েছে, হেঁটে গেলে প্রেয়ারের আগে পৌছতে পারবেন না। আর তাই স্যার গান্ধীর সাইকেলে চালকের আসনে আর গান্ধী রড-এ। আর সে কি সাইকেল চালনা! চোখের পলকে আমাদের সবাইকে পেরিয়ে, স্কুলটাইমের ঐ ভীড়ের মধ্যেও আক্ষরিক অর্থেই পাঁইপাঁই করে সাইকেল চালিয়ে সবার আগে স্কুলে পৌছলেন। আমরা পৌছে দেখি, মাঠের মাঝখানে সাইকেল হাতে গান্ধীবাবা দাঁড়িয়ে আর স্যার সেই হন্‌হনিয়ে হাঁটছেন।

সপ্তাহে তিন দিন সন্ধ্যাবেলায় পড়তে যেতাম ‘অঙ্কের জাহাজ’ নামে খ্যাত অনাদিবাবুর বাড়ি। সেখানেও বাহন সাইকেল আর এক্ষেত্রে সঙ্গী এক ক্লাশের সিনিয়র তুহিন। ওকে তুহিন’দা বলছিনা দেখেই বুঝতে পারছেন নিশ্চয় যে ছেলেটা নিছক সিনিয়র নয় বন্ধুই। যাওয়া-আসার পথে কত সুখ-দুঃখের কথা হত – যেমন কেমন করে আরো জোরে বল করা যায়, গড়াই এর আউটটা শিওর ছিল, কালকে ইংরিজী টিউশনে অমুক তুহিনের দিকে ৫ বার আড়চোখে তাকিয়েছে আর ভূগোল টিউশনে তমুক আমার দিকে বোধহয় ৩ বার ও তাকায়নি – এইসব আরকি। আর এসব কথা বেশিরভাগটা ফেরার সময়ই হত। কারন আমার মতে দুটো। প্রথমতঃ তখন রাত্তির সাড়ে ন-টা মানে প্রায় সেদিনটা শেষ আর জীবনের মত, দিনেরও শেষেই তো সুখ-দুঃখের হিসেবটা জমে বেশি। দ্বিতীয় কারনটা ছিল প্রায় নিয়ম করে লোডশেডিং। অন্ধকার রাস্তাটা এইসব অমুল্য হিসেব-নিকেশের জন্য আদর্শ। ফেরার রাস্তাটাও তাই সবসময়ই দীর্ঘতর হত। এখনো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেটাই দেখি। তুহিন ছিল আগের ক্লাশের ফার্স্টবয়। কিন্তু তার জন্য যে ভালোছেলে মার্কা মেকিপনার কোন দরকার নেই, সেটা তুহিনকে দেখেই আমার শেখার শুরু। কথায় কথায় অমলিন হাসি আর মাঝেসাঝে কাঁচা খিস্তিও যে জীবনে দরকার সেটা যখনই ভুলে যাই, এই পথটা আবার পেরোতে ইচ্ছে করে। জানি সেই লাল হিরো সাইকেলটা বাবা মাঝেমাঝেই মুছে রাখে, তেলও দেয়, এই আমিই শুধু শুধু সেখানে পৌছতে পারিনা।

মনখারাপের সাতকাহন

মনখারাপের নানা প্রকারভেদ যুগে যুগে, দেশে দেশে কবি, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী ও মাতালেরা অনেক দিয়েছেন। আমি জানিনা আমি যেভাবে ভাবনাটা ভাগ করতে চলেছি সেটা তাদের কারোও সাথে মিলে যাবে কিনা। গেলেও ক্ষতি কিছু নেই। একটু না হয় মনখারাপই করে নেবেন ওঁরা।

আমার কাছে মনখারাপ দুইরকম – একপ্রকারে আপনার চোখে জল আসবে, সকলকে লুকিয়ে দু-এক পশলা কেঁদেও নেবেন আপনি। দ্বিতীয়টাতে কান্নাটা আসি আসি করেও আসবে না। গলার কাছটা দলা পাকিয়ে থাকবে। প্রথমটা আমার জীবনে এসেছে, বেশ কয়েকবার এসেছে। এই যেমন ‘তারে জমিন পর’ বা ‘দ্য বয় ইন দ্য স্ট্রাইপ্‌ড পাজামাস্‌’ সিনেমাটা শেষ হল যখন। অথবা ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ তে মা-খেগো বলরাম বা ‘লোটাকম্বল’-এ পলাশের এর মাতামহের মারা যাওয়ার বর্ণনাটা। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে পড়েছিল। তবে আজ আমি দ্বিতীয় রকমটাই আপনাদের সাথে ভাগ করে নেব। দেখি গলার দলাটা একটু যদি হালকা হয়।

মেঘপিয়নের ব্যাগের ভিতর মন খারাপের দিস্তা/মন খারাপ হলে কুয়াশা হয়, ব্যাকুল হলে তিস্তা
খুব কচিবেলার যে ঘটনাটার কথা আমার মনে আছে সেটা আমার ৯ কিলোমিটার দূরের মামাবাড়িতে। মামাবাড়ি ভারি মজা কিল চড় নাই, সে তো ঠিক আছে। কিন্তু সেদিন যে আমার পিসতুতো দাদা তার মামাবাড়ি অর্থাৎ আমাদের বাড়ি আসছে। সেই পিসতুতো দাদা, যে যদিও থাকে বর্ধমানে, আমার মনে হত অন্য গ্রহের মানুষ। তা হবে না? বর্ধমানে বড়লাইনের ট্রেন চলে, দাদাটি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে, শুধু পড়ে না বছর বছর ফার্স্ট হয় আর কাঁড়ি কাঁড়ি প্রাইজ পায়, নিজেদের গাড়ী চড়ে, বাড়িতে ভি.সি.আর. আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তা সে আসছে, আর আমি মামাবাড়িতে পড়ে। খুড়তুতো দাদা আর ভাই মিলে সবটা পেয়ে যাবে তার। এ কি সহ্য হয়। তাই সকাল থেকে মন মেঘলা। মা কিছু বুঝতে পারে, মা-রা সবসময়ই পারে সে আর নতুন কথা কি! বলেই ফেললাম মনোকষ্টের কারন। মা তার ভাইদের বলে ব্যবস্থা করল আর আমরা ফিরলাম বাড়ি। পিসতুতো দাদাকে বোধহয় একঘন্টার বেশী খুড়তুতো দাদা-ভাইদের হাতে ছাড়তে হয়নি।

লাল খেরোর খাতা

উৎসঃ ইন্টারনেট।

সরস্বতী বিদ্যেবতী, তোমায় দিলাম খোলা চিঠি/ একটু দয়া করো মা গো বুদ্ধি যেন হয়
এরপরের ঘটনাটাতেও মা একটা মুখ্য চরিত্র। সিক্সে উঠেছি, গরমের ছুটি। আমাদের পারিবারিক মাস্টারমশাই অঙ্ক করাতে ভালোবাসতেন আর আমিও বছরের শুরুতে টাটকা অঙ্কে মন দিতাম বেশী। সেবছর লাল শালুর মলাট দেওয়া বাবার পুরোনো হিসেবের খাতায় হচ্ছে অঙ্ক। খাতার পাতাগুলো এত ভাল আর সাদা হত যে নিজেই চেয়ে নিয়েছিলাম একখানা পুরোনো খাতা। ১৭ কি ১৮ তম অনুশীলনী তে ছিল সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্ক। নতুন সিড়ি ভাঙ্গতেও শিখে গেলাম, সে কি উত্তেজনা। একদিন সন্ধেবেলা দেখি খাতাখানা খুঁজে পাচ্ছি না। উথালপাতাল খুঁজলাম তাও পাচ্ছি না। অগত্যা মায়ের শরণাপন্ন। মাও প্রথমে এর আগের অনেক জিনিসের মত খুঁজে পেয়ে যাবে বলে আমাকে একটু বকাবকি করলো। সে আমি গায়ে মাখলাম না – কুছ পানে কে লিয়ে ডাঁট খানা পড়তা হ্যায়। কিন্তু খাতার বিবরণ শুনে দেখি মায়ের মুখটা একটু কেঁপে গেল। প্রথমে আমিও পাত্তা দিইনি। আস্তে আস্তে দেখলাম আমি মিথ্যে বললে মা যেমন বুঝতে পারে, তেমন করে আমিও আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি ডালমে কুছ কালা হ্যায়। শেষমেশ যা বুঝতে পারলাম, মা না বুঝতে পেরে পুরোনো খাতা ভেবে ফেলে দিয়েছে। বেজায় কষ্ট পেয়েছিলাম। মা অনেক করে বুঝিয়েছিল যে অঙ্কগুলো আবার করলে ভাল বই মন্দ হবে না। কিন্তু মা কি করে বুঝবে প্রথম বারের উত্তেজনা আর ফিরবে না।

শচীন

উৎসঃ ইন্টারনেট।

খেলছে শচীন খেলছে শচীন মারছে শচীন ছয়/ খেলছে শচীন খেলছে শচীন মারছে শচীন চার
পরের ঘটনাটা আর একটু বড় হয়ে। এইট বা নাইন এ পড়ি। বহুদিন পর পাকিস্তান এসেছে টেস্ট খেলতে ভারতে। এবং সে এখনকার পুতুপুতু পাকিস্তান নয়, রীতিমত ওয়াসিম, ওয়াকার, শোয়েবের গনগনে আঁচ। চেন্নাইতে খেলা হচ্ছে। হেরে যাওয়া ম্যাচ পিঠের অসহ্য ব্যথা উপেক্ষা করেও ভগবান তার নিজের মহিমায় প্রায় জিতিয়ে দিচ্ছিলেন। বাড়ির সবাই একতলায় সাদাকালো টি.ভি. তে চোখ ঠেকিয়ে। আমি কুসংস্কার বশতঃ দোতলায় রেডিও কানে। শেষবেলায় ভগবান আর পারছিলেন না, মেরে আউট হয়ে গেলেন। মাত্র ১৭ রান দূরে জয় দেখা যাচ্ছে, হাতে তখনো তিন-তিনটে উইকেট। আর কুম্বলে, শ্রীনাথরা বড়লোকের বাউন্ডুলে ছেলের মত ৪ রানের মধ্যে সব আউট। কষ্টটা দলা পাকিয়েছিল অনেকক্ষণ, ভাবছিলাম ভগবান কি ভাবছেন। আজ রাত্তিরে খেতে পারবেন? মাঠে খেলতে গিয়েও খেললাম না দেখে বন্ধুরা যখন জিজ্ঞাসা করল কারণ কি, বললাম ‘মন ভালো নেই’।

মন রে কৃষিকাজ জানো না
পরের ঘটনা কলকাতার উপকন্ঠে মিশনের আবাসিক কলেজে। একটা বেশ কঠিন সাবজেক্টের পরীক্ষা চলছে। সাবজেক্টটি ছিল আই.সি. (Indian Culture) – ১৬-১৭ বছরের পক্ষে বেশ কঠিন কঠিন কনসেপ্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন খোদ প্রিন্সিপাল মহারাজ। আসলে তখন সবে সবে মিশনের পরিমণ্ডলে এসেছি। ছিলাম কুঁয়োর ব্যাঙ, আর সেখান থেকে সরাসরি স্বামীজির মানুষ গড়ার কারখানায়। মানুষ – অতি সাধারণ মানুষই যে দেবতা সেই কথাটাই তখন নতুন শুনছি। তার আত্তীকরন, প্রতিবাদ, যুক্তি-প্রতিযুক্তি তখন বহুদূর। সারভাইভ করতে হবে। নিজেকে নিয়ে সযত্নে গড়ে তোলা মুগ্ধতার আবরণ যখন খসে পড়েছে, তখন নিজেকে বাঁচাতে শরণ নিলাম অসাধুতার। মিশনে ছোট থেকে পড়াশুনো করা নরম মনের বন্ধুটিকে রাজি করালাম, ‘ভাই পরীক্ষাটায় একটু উৎরে দিবি?’ আমার মুখ দেখে করুণা হওয়ায় সে রাজি হল। বন্দোবস্ত হল, সে লিখে তার পাশে রেখে দেবে, আমি পিছনের বেঞ্চ থেকে পাশমার্কটুকু তুলে নেব। কিন্তু বিধি বাম। সেই ঘরের গার্ডকে আড়াল করে লিখছিলামও (আই মিন টুকছিলাম)। শমন যে পাশের ঘরে ওত পেতে আছে, তা কেই বা জানত। পাশের ঘরের গার্ড ফেললেন ধরে। সঙ্গে সঙ্গে দুজনকেই পাঠানো হল মহারাজের ঘরে। যাওয়ার সময় শুধু ভাবছিলাম, শেষ পর্যন্ত আমিও! ত্যাগী ও জ্ঞানী মানুষটি শুধু একবার তাকালেন আমাদের দিকে। সর্বাঙ্গে গেরুয়া পরিহিত মানুষটির সেই মুখ আমি কখনো ভুলব না। পরিধানের গেরুয়া বর্ণের সঙ্গে মুখের রঙের কোন পার্থক্য করা যাচ্ছিল না। রাগ বা লজ্জা যা-ই থেকে থাকুক না কেন সেই দৃষ্টিতে, তিনি শুধু বললেন, ‘যাও’। পড়ে আসা বিকেলের মধ্যে দিয়ে আমি আর সেই বন্ধুবর ফিরে এলাম হস্টেলের দিকে। বন্ধুর কাছে যথোচিত ক্ষমাপ্রার্থনার পরে, হস্টেল পেরিয়ে চলে গেলাম মাঠের দিকে। মনখারাপ করা বিকেলটা কাটলো অনেকক্ষণ ধরে । রাত্তিরে মহারাজ ডেকে পাঠালেন। জীবনে চলার কয়েকটা পাথেয় দিলেন। যখনই আবার ‘সারভাইভ’ করার মত পরিস্থিতি এসেছে, ঐ পাথেয় থেকে ঠিক ঠিক রসদ সংগ্রহ করা গেলে, দেখেছি ঠিক বেঁচে গেছি।

ও মনরে, স্বপ্ন দেইখা রইলি ভুলে/ আমার এই স্বপন কি মিথ্যা হইতে পারে রে
এর পরের ঘটনাটাও ঐ সময়েরই। ফিজিক্স টিউশনে গিয়ে দেখি এ আমাদের কীর্ণাহারের মাটিতে গোল হয়ে বসে পড়া নয়। এখানে পুরোদস্তুর বেঞ্চ-টেঞ্চ আছে, এমনকি মাইনে দেওয়ার রেজিস্টার মেইন্‌টেইন করা হয়। এখানেই সে-ও পড়ত। মাধ্যমিকে ফিজিক্সটা অ্যাডিশনাল ছিল, তাই দু-একটা অঙ্ক এগারো ক্লাশেও চেনা-পরিচিত বেড়িয়ে যেত। এরকমই একদিন দু-একটা অঙ্ক নামিয়ে ফেললাম তাড়াতাড়ি। দেখি সে পাশে বসে আছে অবাক দৃষ্টিতে। না চাইতেই, তাকেও একটু হেল্প করে দিলাম। সে শুধু বলল, ‘বাহ্‌ তুই তো বেশ সহজে বোঝাতে পারিস। তোর কাছে মাঝে সাঝে কিছু জিনিস দেখিয়ে নেব।’ মন ভাবল, ‘এ কি শুনলাম’? মন প্রশ্ন করল, আবার ‘মাঝে মাঝে’-টা কেন? মন ঠিক করল, ‘ফিজিক্সটা ঠিকঠাক পড়তে হবে। আর মুখে বললাম,’আরে সে তো অবশ্যই। আমি পারলে কেন দেখিয়ে দেব না’? কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তার পরের দিন সে আর পাশে বসল না, তার পরের দিনও না, তার পরের দিনও না। মন বলল তাতে কি হয়েছে? অঙ্ক আবার আটকাবে। তারপর একদিন দেখলাম কলেজের দোতলার বারান্দায় কাগজফুলের গাছটার পাশে, রেলিং-এ ভর দিয়ে সে দাঁড়িয়ে। লম্বা বারান্দার শেষে আমায় দেখতে পেয়ে মুখ তুলে জলভরা মেঘ ছড়ান হাসিটা হাসল। ধড়ফড় করে জেগে উঠলাম আমি হোস্টেলের সেই ৩ ফুট বাই ৭ ফুট তক্তাতে। মনটা এক ঝটকায় খারাপ হয়ে গেল। এরকম করে কি ভয় পাইয়ে দিতে আছে? স্বপ্নটা আর একটু চললে কি-ই বা ক্ষতি হত? আসলে বাস্তবে যে স্বপ্নটা ভাঙতে চাইছিল না, স্বপ্ন এসে সেই স্বপ্নের ‘দ্য এন্ড’ করে দিলো। ভাঙা মন নিয়ে বাকি রাতটুকু জেগেই কাটলো।

এখনো সামনে পথ হাঁটা বাকি/ চাইলেও দিতে পারবে না ফাঁকি
বেশ অল্পবয়সেই বাড়ির বাঁধন কেটে বের হয়ে আসাটা আমার একটা প্রচ্ছন্ন গর্বের জায়গা ছিল। আর সেই গর্বের জায়গা থেকেই ভাবতাম, যে আমি এগারো ক্লাশ থেকে বাড়ির বাইরে, তার কি আর বিদেশ যাত্রায় কিছু কষ্টের থাকতে পারে? পারে,- আর সেটা বুঝলাম একটু অদ্ভুত ভাবে। চাকরির শেষদিন আর কম-সে-কম পাঁচ বছরের জন্য বিদেশ যাওয়ার দিনের মাঝে দিন কুড়ি সময় ছিল। সেই সময়টা কাটালাম বাড়িতে। টানা কুড়ি দিন এর আগেও কাটিয়েছি বাড়িতে কিন্তু এইটা অন্যরকম। বাবা দেখি থেকে থেকে যা যা খেতে ভালোবাসি নিয়ে আসছে, সকালে অস্বাভাবিক রকম দেরী করে ঘুম থেকে উঠলেও মা কিছু বলছে না। শেষের দিনটা হঠাৎ করে যেন বুঝতে পারলাম, হুট্‌ বলতেই টুক করে চলে আসা যাবে না, এইরকম একটা জায়গায় পাড়ি জমাচ্ছি। যেই না মনে হওয়া, অমনি মন বলল ‘আমার ভালো লাগছে না’। সারা সকাল মুখের যা অবস্থা হয়েছিল, সে কহতব্য নয়। সেদিনের কিছু ছবি এখনো আছে। যদি বলেন, ‘দেখি সে ছবি’, এখন থেকেই বলে দিচ্ছি প্রাণ থাকতেও সে আমি পারব না। আমার সেই বাংলার পাঁচের মত মুখ দেখে আপনাদের মুচকি হাসি – দৃশ্যটা কল্পনা করেই আমার একটা জঘন্য রকমের ইয়ে হচ্ছে।

উনকি বাঁতো কা জরাসা ভি অসর্‌ মত্‌ লেনা/ ওয়রনা চেহ্‌রে কি তাসুড় সে সমঝ্‌ জায়েঙ্গে
পরের ঘটনাটা এই পরবাসে। তবে ঘটনার মাধ্যম আন্তর্জালিকা – স্যোশাল নেটওয়ার্ক। ছবি দেখে মুগ্ধ হলাম। আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে অঙ্ক আটকানোর অপেক্ষায় বসে থাকলে আর হবে না। শুরু করলাম ভার্চুয়াল পত্রালাপ। অবশ্য একতরফ থেকে মাসে তিনটে আর অন্য তরফ থেকে তিন মাসে একটা মেসেজ যাওয়া আসা করলে তাকে রসিকজন হয়ত পত্রালাপ নাও বলতে পারেন। তবে যে চিঠির উত্তর পেতাম বা বলা ভাল যেদিন পেতাম নিজেকে জাস্ট রাজা মনে হত। একবার লিখেছিলাম ফোন নম্বর দেওয়ার জন্য। তাতে সে বলল, ফোনে কি আসে যায়! মেনে নিলাম। মাঝখানে সাত সমুদ্রের ফারাক, তবু একটা অক্ষম চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। একদিন হঠাৎ করেই বালির বাঁধ গেলো ভেঙে। সে নিজেই জানালো সে অন্য কারো বাগদত্তা। ব্যাপারটাতে তেমন মনখারাপ হয়নি, কারন বোধহয়, ইঙ্গিতটা ছিলই। মনখারাপটা কখন হলো জানেন? যখন সে বলল (আমারই চাপাচাপিতে) যে সে অনেকদিন থেকেই জানত তার প্রতি আমার সফ্‌ট কর্ণারের কথা। তাহলে আগে বললো না কেন? মনকে বোঝালাম, মনটা যাতে ভেঙে না যায় তাই সে এতদিন কিছু বলেনি। মন দেখলাম ফুরফুরে হয়ে গেল। গেল কি?

পুজোর এদেশ ও সেদেশ

পুরাকালে পুরুষোত্তম রাম, রাবণ মারতে দুগ্‌গা ঠাকরুণের ঘুম ভাঙিয়েছিলেন। আমেরিকা নিবাসী বঙ্গপুঙ্গবেরা একেবারে পুরুষোত্তম না হন, কাছাকাছি তো! তাই ‘পুজো করার’ উদ্দেশ্যে অকালবোধনেরও অকালবোধন ঘটিয়ে থাকেন। এ ঐ পর্বতের মহম্মদের কাছে আগমণ আর কি। সে হপ্তার মধ্যে মা যতই এসে চলেও যান, অফিস-কাছারি, স্কুল-কলেজ শিকেয় তুলে তো আর মা-র আরাধনা হয় না। সে মা-ও জানেন। আর তাই সপ্তাহান্তে প্রবাসী বাঙালী আয়োজন করে মিনি- পুজোর।

এরকমই এক পুজোর আবহে, আমার চোখে, এদেশ ও সেদেশ (নাকি শুধুই দেশ) এর পুজোর একটা পাঁচালী আমি লিখতে বসেছি। আমার সেদেশের পুজোটা আবার ঝাঁ চকচকে আলো, প্যান্ডেল আর এগ্‌রোল-চাউমিনের জোরে সারারাত পুজো পরিক্রমা একেবারেই নয়। রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ-পূর্ব বীরভূমের এই শান্ত জনপদটিতে যেকোনো পুজো-পার্বন ছিল সত্যি সত্যিই ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’র সাথে নিবিড় আলাপচারিতা। যেখানে মা এর সাথে গ্রামের বাইরে থাকা ছেলেমেয়েরাও একটু জিরোতে আসে। কেরিয়ারের স্বার্থে এগারো ক্লাশ থেকে কলকাতা নিবাসী হলেও পুজোটা কোনদিনই কলকাতায় দেখিনি। ছাত্রাবস্থায় ক্লাশটেস্ট ইত্যাদির ঝামেলা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাঙ্গ করে দ্বিতীয়া বা তৃতীয়া তেই বাড়ি। ক্ষুদ্র চাকরী জীবনে অতটা নির্লজ্জ চাইলেও হতে পারিনি, অগত্যা সপ্তমীর সকাল। আরো ছোটতে অবশ্য ঠিক কবে আমার পুজো শুরু হত, হিসেব কষে বলা খুব মুশকিল। সেটা রথের দিন মূর্তি তৈরী শুরু থেকেও হতে পারে, মহালয়ার আধভাঙ্গা ঘুমে বীরেনবাবুর গলায় ‘যা দেবী সর্বভূতেষু …’ শুনেও হতে পারে, বা পঞ্চমীর সকালে সিংহের থাবায় রক্ত থুড়ি লাল রঙের শেষ পোঁচ লাগানোর সময়টাও হতে পারে। মোদ্দা কথা, পুজো আসা না আসা নিয়ে অত চাপ ছিল না। যেমন ভাবে গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা এসে শেষ হয়ে গেল, হাফ্‌ইয়ারলিও শুরু হয়ে শেষ হয়ে গেলো, পুজো – সেও আসবে ঠিক। মূর্তি গড়ার ব্যাপারটাতেও ছিল একটা বনেদী আলস্য। যদিও বারোয়ারী পুজোর সংখ্যা ও জাঁকজমক অনেককালই বাড়ির পুজোগুলোর থেকে বেশী, এই একটা ব্যাপারে তাদের মধ্যে বেশ মিল। মূর্তি গড়া হত হয় মণ্ডপে, না হয় একদম কাছে কোনও আটচালাতে। আর তা দেখতে পাঠশালার ছাত্রদের অবস্থা যা হত, সেটা বলা আছে সনৎ সিংহের গানে – ‘মন বসে কি আর?… না না না, তাক তা ধিনা, তাক তা ধিনা, তাক কুড়কুড়, কুড়ুর কুড়ুর তাক’৷ কলকাতায় দেবী সাধারনত ট্রাকবাহিত হয়ে কুমোরটুলি থেকে যান মণ্ডপে আর মার্কিন দেশে দেবীর আক্ষরিক অর্থেই নৌকায় আগমন – অর্থাৎ কিনা, মহাসমুদ্র পেরিয়ে জাহাজবাহিত হয়ে পা দেন স্যাম চাচার দেশে। এই জার্নির ধকল সহ্য করার জন্য মা মৃন্ময়ী নন, আরো রোবাস্ট কিছু যেমন ফাইবার গ্লাস বা শোলার। গীতায় বর্ণিত ‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি, নৈনং দহতি পাবকঃ’ … পুরোদস্তুর না হলেও ছোটখাটো দুর্বিপাক সহ্য করার ক্ষমতা এ মূর্তির থাকে।

মূর্তি তো এসে গেল। এবার তার পুজোর জায়গা খোঁজার পালা। বাড়ির পাশের মাঠে বা রাস্তা আঁটকে বাঁশ (বা মাটির ভাঁড়) এর প্যান্ডেল খাড়া করে পুজো তো আর সম্ভব নয়। তাই ডলার গুনে চার্চ, স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান হল ভাড়া করতে হয়। এগুলোর ভাড়াই সবথেকে কম। অবশ্য সে ব্যবস্থা করতে গিয়েই যদি ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয় তাহলে একটু বড় মাপের বাড়ির গ্যারাজেও পুজো হতে পারে। ভক্তি বা আনন্দের অবশ্য কোথাওই কমতি পড়ে না। আনন্দ সবথেকে বেশী করে যথারীতি বাচ্চা বা কচিকাঁচারা। অনভ্যস্ত দেশীয় জামাকাপড়ে মানিয়ে নিতেই একটু যা সময় লাগে। তারপরই শুরু করে দেয় দাপাদাপি। সবথেকে মারাত্মক হলো, হঠাৎ করে সবাই মিলে – লেটস্‌ রান – বলে এদিক সেদিক দৌড়নো শুরু করা। সেক্রেটারী কাকুকে ডজ্‌ করে, মিত্র কাকীমাকে সাইডে রেখে যেই একটু উসেইন বোল্ট স্টাইলে পিছন ফিরে অন্যদের অবস্থাটা পর্যালোচনা করতে গেছে – দুম্‌। লাগলো ধাক্কা সান্যাল জেঠুর সঙ্গে। সে তো উঠে-টুঠে গা ঝেড়ে আবার শুরু করতে যাবে, এমন সময় মঞ্চে আবির্ভূত হন তার রাশভারী বাবা। একটু চাপা শাসন – “বিল্টু, ডোন্ট রান লাইক দিস্‌। পড়ে গেলে কিন্তু লেগে যাবে।” বিল্টু একটু নতমস্তকে শুনে নেয় কথাগুলো আর তার বাবা ফের ছেড়ে আসা আড্ডায় ফিরতে না ফিরতেই সে-ও শুরু করে দেয় নতুন দৌড়।

হ্যাঁ, আড্ডা। যদিও সত্যজিৎ বাবু ‘আগন্তুক’ সিনেমায় রবি ঘোষ কে দিয়ে বলিয়েছেন, “রবীন্দ্রনাথ তো আড্ডা দেন্‌নি”, তবু বাঙালীকে আড্ডাহীন করা মানে যে বেজায় গাড্ডায় ফেলা, সে পাঠকমাত্রেই স্বীকার করবেন। আড্ডার চরিত্র থেকে অংশগ্রহণকারীদের সম্বন্ধে কিরকম ধারনা করা যায় দেখুন। আড্ডার টপিক গ্রীণকার্ড, H1B, ভিসা, অনসাইট, টেনিওর এইসব হলে বুঝতে হবে আড্ডার পাত্রপাত্রীরা এদেশে চাকুরীরত/রতা বা পোস্টডক বা অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর বা অনসাইটে আসা সফটওয়্যার প্রফেশনাল। গড়িয়াহাট, শাড়ি, ছেলেটা এত দুষ্টু হয়েছে ইত্যাদি – উপরিউক্তজনেদের স্ত্রী বা উপরিউক্ত পেশাস্থিত মহিলা বা দুটোই। একটু গম্ভীর, একটু উৎকণ্ঠিত, পুরোনো কারো সাথে দেখা হলে কাষ্ঠ হাসি – বুঝতে হবে ইনি পি.এইচ.ডি. র শেষদিকের ছাত্র বা ছাত্রী। পাটভাঙ্গা পাঞ্জাবী বা শাড়ি পরিহিত ইতি-উতি চাউনি, চোখেমুখে প্রবল উৎকণ্ঠা – সদ্য আগত পড়ুয়া। একটু কেয়ারলেস্‌ ভাবে ব্যস্তসমস্ত – বছর দুয়েকের পুরনো পাপী। এইরকম আর কি। এবার বরং আড্ডা ছেড়ে মূল পুজোয় ঢোকা যাক।

মূল পুজোর দায়িত্বে থাকেন একজন পুরোহিত। এই হট্টমেলার আসরে সবথেকে বেকায়দায় বোধহয় তিনিই পড়েন। নিজ কর্মক্ষেত্রে তিনি হয়ত একজন কৃতী। কিন্তু দেশটা পৈতেপরা পুরুত ঠাকুরের না হওয়ায় তিনিই এখন এ পুজোর মেক্‌শিফট পুরোহিত। এমনিতে যে জায়গায় তার নিত্য ওঠাবসা সেখানে পান থেকে চুন খসে না। আর এখানে পান পেলেন তো চুন পেলেন না! তবে পাওয়া এখানে সবই যায় – মাটির ঘট, কচি ডাব, সিঁদুর, কর্পূর মায় কৌটোয় ভরা গঙ্গাজল অব্দি। তবে এ পুরুত মশাই তো আর আদতে পুরুতমশাই নন, তাই অত জিনিসের মাঝে একটু আতান্তরে পড়ে যান আরকি। তা যা-ই হোক, পুজো কিন্তু উনি ভালোই উতরে দেন। এমনকি সন্ধি পুজোও ঠিক ২৪ মিনিটেই শেষ হয়ে যায়। তবে কিনা এটা যাকে বলে একটু থ্যাঙ্কলেস্‌ জব। নাহ্‌, ধন্যবাদ উনি প্রচুর পান (এদেশে তো লোকে উঠতে বসতে ধন্যবাদ দেয় – সেকথা আলাদা)।iকিন্তু দ-ক্ষি-ণা? সে এক মহাকষ্টের আখ্যান। ডলারেই পান উনি দক্ষিণা, কিন্তু সবটাই জমা হয় পুজোর ফান্ডে।

বাঙালির পুজো আর খাওয়া-দাওয়ার তোড়জোড় থাকবে না তা কি হয়? এখানটাতেও বাঙালি ব্যাপারটার বাঙালিকরণ করে ফেলেছে। শহুরে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স নিবাসী বাঙালি পুজোর সময় রান্নাঘরমুখো হয়না। হয় প্যান্ডেলের ধারের অস্থায়ী রান্নাঘর থেকেই খাবার আসে আর না হলে রাস্তার ধারের স্থায়ী রোলের দোকান থেকে উড়ে যায় রোল-চাউমিন। গ্রামগঞ্জে ব্যাপারটা এখনো সেরকম নয়। পুজো বলেই বাইরে খাওয়া – এই ব্যাপারটা এখনো সেরকম জমেনি। আর তাতে করে মা-কাকিমাদের কষ্ট বাড়ে বই কমে না। নির্ঘন্ট অনুয়ারী মায়ের পুজোর জোগাড় করার সাথে সাথে পরিবারের মুখে ভালোমন্দ তুলে দেওয়াটা যে বছরের পর বছর তারা করে যেতে পারেন সে বোধ হয় এই দুগ্‌গা ঠাকরুণেরই কৃপায়। প্রবাসে এ দুইয়ের মাঝামাঝি একটা পন্থা অবলম্বন করা হয়। এখানে তো আর রাস্তার ধারে রোলের দোকান নেই, আর প্রতিমার পাশে হাঁউমাঁউ আগুন জ্বালিয়ে রান্না করারও অনুমতি নেই। তাই নামকরা বাংলাদেশী দোকান বা কোন বাঙালিরই চালু করা ছোটখাটো কেটারিং ব্যাবসা থেকে খাবার আনানো হয়। আর পরিবেশনের দায়িত্ব কোমর বেঁধে নেয় সব্বাই মিলে। রাস্তার ধারের রোল-ফুচকার অভাব পূরণ করার চেষ্টাও থাকে কোথাও কোথাও। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের অপটু হাতে ফুচকা বা রোল বানিয়ে স্টল দেয়। আর নস্টালজিক বাঙালি তার গাঁটের ডলার খরচ করে হাপুস্‌-হুপুস শব্দে পুজোপ্রাঙ্গন ভরিয়ে তোলে।

দুদিনের পুজো এই করেই শেষের দিকে চলে আসে। বুঝতেই পারছেন এতো কাঠখড় পুড়িয়ে আনা মূর্তি জলে যায়না। সে যায় আবার গ্যারাজ বন্দি হতে। ভাসানের নাচের সুযোগ না থাক, ধুনুচি নাচ বা সিঁদুর খেলা কিন্তু বাদ যায়না। উঠোন বাঁকা বললেও রেহাই নাই কারও। নাচতে একটু হবেই।

পুজো শেষ। বিজয়াও হয়। দেশের মতো বাড়ি বাড়ি ঘুরে পেট আইঢাই করা ঘুঘ্‌নি আর নারকোল নাড়ু সাবড়ে হয়না হয়তো, তবু হয়। যে যার দৈনন্দিন কাজকর্মে ফিরে যাওয়ার আগে পুজো মণ্ডপেই ছোটরা বড়দের প্রণাম করে, বড়রা ছোটদের আশীর্বাদ করেন আর সমবয়সীরা করে কোলাকুলি। মা দুগ্‌গাও কৈলাশের পথ ধরেন, আর তাঁর সেবকরাও এই বিদেশ-বিভুঁয়ে একটু মন খারাপ আর এক বছরের অপেক্ষা বুকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরে।

আমার প্রাইমারি বেলা

(এই লেখাখানা ‘কথা’-য় আমার প্রথম লেখাও বটে। সুনন্দ আর সংহিতা কে অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটা কথা’য় প্রকাশ করার জন্য ও আমার বানান গুলো ধৈর্য ধরে বসে ঠিক করে দেওয়ার জন্য)

প্রাইমারি উত্তর জীবনে কোথাও শুনেছিলাম যে, ‘প্রাইমারি’ স্কুল হল সেই স্কুল যেখানে শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রায়ই মারেন। আমার অভিজ্ঞতা অতটা করুণ না হলেও কথাটা বেশ মনে থেকে গেছে। বরং উল্টোটাই আমার কাছে সত্যি। হাইস্কুলেই প্রহারের প্রয়োজন ও প্রয়োগ যেন বেশি। হাইস্কুলের কথা পরে হবে ’খন। আজ খুলছি প্রাইমারি স্কুলের ঝাঁপি। চিন্তা নেই, শুধু করুণরসেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এই গল্পগাথা। অন্যান্য জিনিসপত্রও থাকছে!
একদম শুরুতে, শহরের ছোঁয়া পাওয়া আমার গেঁয়ো বাবা-মা আমার নাম লেখালেন গ্রামের একমাত্র ইঞ্জিরি মিডিয়াম প্রাইমারিটিতে। আইডিয়াটা ছিল, বছর দুয়েক ইঞ্জিরি শিক্ষানবিশি করে, ইংরাজির ভিতটা একটু পোক্ত করে – ‘বাংলায় ফিরে এসো বাওয়া’।iদু-একজন তুতো দাদার ক্ষেত্রে এইরকমটিই হতে দেখেছি কিনা। সে যাই হোক, শুরু হলো লাল জামা, কালো প্যান্ট, কালো টাই (সেটা আবার নট্‌ করাই থাকত, গলায় গলিয়ে নিলেই হত), কালো জুতো (মোজার রঙ ভুলে গেছি) পড়ে বিদ্যাদেবীর আরাধনা। ওহ্‌, বলতে ভুলে গেছি, সাথে সবুজ ফিতেওয়ালা ওয়াটার বটল্‌, টিনের বাক্স আর সেই বাক্সে কিছু বই আর রুলটানা খাতার সাথে আকাশী রঙের টিফিন বাক্সও ছিল। কিন্তু ছিলো না একটা জিনিস। অনেককেই দেখতাম খাঁচাগাড়ি করে স্কুলে আসত। বাড়ি থেকে ইস্কুল মেরে-কেটে ৩০০-৩৫০ মিটার হওয়াতে আমি ছিলাম ও সুখে বঞ্চিত। বেজায় রাগ হত জানেন। পরে অবিশ্যি, কি কারনে মনে নেই, একবার সুযোগ হয়েছিল এতে চড়ার। সেই ‘রঙ দে বসন্তী’ তে কুণাল কাপুর যেরকম বলেছিলেন না, – ট্রেনে ৩ জনের সিটে ৬ জন বসে, আর তারপর সপ্তম জন এসে বলে ‘ইয়ার থোড়া অ্যাডজাস্ট করলে’ – আমার অবস্থাও সেরকমটিই হয়েছিল। কাজেই নাক কান মুলেছিলাম – খাঁচাগাড়ি, কভি নেহি। আমার ক্ষেত্রে কেন কে জানে এই স্কুলে থাকার মেয়াদ এক বছর বেড়ে গেল, অর্থাৎ কিনা ৩ বছর আমায় সেখানে রাখা হল। হয়ত আরো দুবছর রেখেই দেওয়া হত, কিন্তু সে গুড়ে বালি। আমার এক মামাদাদু তখন উত্তর কীর্ণাহার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার। তিনি এসে তার ভাগ্নীকে (অর্থাৎ আমার মা-কে) বললেন, ‘কিরে তোর এই ছেলেটাকে কবে আমার হাতে দিবি’? আর সেই বছর শেষেই আমি চলে গেলাম উত্তর কীর্ণাহার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। হয়ত, মামাদাদুর এই কথাটা কাকতালীয়, তবু আমার এটা বিশ্বাস করতেই ভালো লাগে। আমিও নিয়ে যাব ওখানে আপনাদের। একটু সবুর করুন, একটা ঘটনার কথা বলে নিই। আমার কপালের ঠিক মাঝখানে একটা গুণ চিহ্নের (x) মত দাগ আছে। তার একটা দাগ হয়েছিল গ্রামের আখড়ায় পড়ে গিয়ে। এটা এতটাই কচি বয়সে হয়েছিল যে আমার কিছু মনে নেই। অন্যটা হয়েছিল, এই ইংরেজি ইস্কুলে। টিফিনের সময় পড়ে গিয়ে স্কুলের গেটের কাছে। কান্নাকাটি তো হয়েইছিল, তবে বেশী করে যেটা মনে আছে সেটা হল, ঐদিন ঠিক টিফিনের পরেই বাড়ি চলে এসেছিলাম, এবং পুরো রাস্তাটাই মা-র কোলে চড়ে। 🙂

যাই হোক এসে গেলাম উত্তর কীর্ণাহারে – লোকমুখে উত্তরপাড়া ইস্কুলে। কি কি বদল হলো জীবনে? সে অনেক। কয়েকটা বলি। প্রথমেই লাল জামা, জুতো, টাই এসব জলাঞ্জলি গেলো। ইউনিফর্ম বলে কিছু নেই এ ইস্কুলে। আমি তো তাও হাওয়াই চটি ফটফটিয়ে ইস্কুলে যেতাম, বেশীরভাগ সহপাঠীই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া হওয়ায় সেটুকুও জুটত না। খালি পা-ই ভরসা। বেঞ্চ-টেঞ্চেরও বালাই ছিল না। তবে তার বদলে একটি অমূল্য জিনিসের মালিক হলাম – একখানা নিজের আসন! ভাবা যায়, একটা ৭-৮ বছরের ছেলের কিনা নিজের একটা আসন! আহ্‌, তা বলে ভাববেন না, সে কারুকার্য করা রাশভারী আসন। আসলে আসন বলছি বটে, তবে ঠিকঠাক আসনেরা একে আসন-কুলীন গোত্রীয় মনে করবে কিনা এ নিয়ে এখন আমার বেজায় সন্দেহ হয়। এটা ছিল একটা খালি বস্তা, চারধারটা সেলাই করা এই যা। তা সে আপনি যতই মুখ সিটকান এ তখন আমার ‘সাত রাজার ধন, এক মানিক’।iবাক্সে করে নিয়ে যেতাম, মেঝেতে পাততাম, বসতাম আবার স্কুল ছুটি হলে ভাঁজ করে বাড়ি। বাক্সের ভিতরের অন্যান্য জিনিসের (মানে বই খাতা আরকি) যত্ন ততটা না হলেও এর জন্য প্রায়ই মা-র কাছে ঝুলোঝুলি করতুম। কেচে-টেচে ফিটফাট করে দিত মা। আর একটু উলোঝুলো হয়ে গেলেই বাবার কাছে বদলির দাবি। বার কয়েক খারিজ হওয়ার পর পেতাম আরেকটা নতুন আসন, থুড়ি বস্তা।
আরেকটা বিশাল চেঞ্জ ছিল মাইনের অ্যামাউন্টে। ইঞ্জিরি ইস্কুল নিত মাসে ২০ টাকা, আর এটি অ-বৈ-ত-নি-ক। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি পরবর্তী ৯ বছরে কখনো মাসে ২০ টাকা করে মাইনে কোনো স্কুলে দিতে হয়নি। উত্তরপাড়ার কথা তো বললাম, হাইস্কুলে দিতে হত বছরে ৬৩ টাকা। বড় দাঁও মেরেছি, কি বলেন? উত্তরপাড়া আবার আগের স্কুলের মত নিতান্ত নবীন নয়, এতে আমার দাদারা তো কোন ছাড়, বাবা-কাকারাও পড়ে গেছেন। আর আমার সময়েও বাবা কাকাদের পড়িয়েছেন এমন গোটাদুই মাস্টারদাদু ছিলেন। একটু বেচাল করলেই মারধোরের থেকেও বেশি ভয় দেখাতেন বাবাদের টেনে নিয়ে আসবেন বলে। তো উত্তরপাড়ায় বেশ চলতে লাগল, কিশলয়-সহজপাঠ-নবগনিতমুকুল নিয়ে। এই বইগুলিও কিনতে-টিনতে হত না। সরকারি বই, পাওয়া যেত বিনি পয়সায়। ছাত্রের তুলনায় বরাদ্দ বই কম থাকায় পুরনো বই-এও কাজ চালাতে হত। আর ঠিক এই কারনেই বছর শেষে সেসব বই ফেরত দিয়ে দিতে হত।
আমার সেই মামাদাদুর গল্প এবার একটু করি। আমার দাদা যখন এ স্কুলের ছাত্র, তখন তিনি দাদাকে বশ করার জন্য মাঝে সাঝে চক দান করতেন। আর তাই কৃতজ্ঞতা বশতঃ দাদা সেই দাদু কাম মাস্টারমশাই এর নামকরণ করল চকদাদু। স্বাভাবিক নিয়মে উনি আমারও চকদাদু হলেন। আমি যখন থ্রি-তে পড়ি, উনি ক্লাস ফোরের কিছু ছেলেমেয়েকে স্কুলের পরে আলাদাভাবে পড়াশুনো দেখিয়ে দিতে লাগলেন। অবশ্যই অবৈতনিক ভাবে, কিছুটা গ্রীষ্মের দুপুরগুলোর সদ্‌গতি করতে আর কিছুটা ছেলেগুলোর ভালো করতে। আমার মা আমায় তাদের সাথে ভিড়িয়ে দিলো। থ্রি-র আমি ছাড়া আর একটি ছেলেই ছিল। হলো কি, আমরাও ঐ ফোরের অঙ্ক, ফোরের বাংলা, ইতিহাস পড়তে লাগলাম। আমার ক্লাসের বাকি ছেলেরা যখন দশমিকের গুণ ভাগ নিয়ে ব্যাস্ত, আমি তখন ল.সা.গু.-গ.সা.গু.-গড়ের অঙ্ক কষছি। খুব আনন্দ হতো জানেন। এখন বুঝি, ওটা বোধ হয় নিষিদ্ধ জিনিস চাখবার আনন্দ। এই একটা কারনে চকদাদুর কাছে আমি চিরঋণী হয়ে থাকব। আজ উনি নেই। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।
এইভাবে চলছিল। ক্লাস ফোরের শেষদিকে হঠাৎ শোনা গেল, মহামান্য সরকার প্রাইমারী স্কুলগুলিতে পঞ্চম শ্রেনী চালু করতে চলেছেন। আমার মা পড়ে গেলেন চিন্তায়। প্রাইমারী স্কুলের নতুন হওয়া সবচেয়ে বড় ক্লাসটিতে আমায় রাখবেন নাকি হাইস্কুলের একদম নিচু ক্লাসটিতে। মা-র ভোট প্রথম অপশনটিতে ছিল, কিন্তু বাগড়া দিলাম আমি। আমার দাবী আমি বড় স্কুলে পড়ব। ঐ নিষিদ্ধ আনন্দ বোধ হয়। তবে একটা ১০ বছরের ছেলের চাওয়ায় আর কবে কি হয়েছে? আমারও হত না, যদি না বাবা চাইতেন। আমি এখনো জানি না, মার মত বদল কি করে হল, তবে সন্দেহ হয় বাবা-ই রাজি করিয়েছিলেন বোধহয়।
সে যাই হোক প্রাইমারীর পাট চুকলো। হাইস্কুলের গল্প অন্য কোনদিন। উচ্চশিক্ষার বেসাতি করতে করতে ক্লান্ত আমি ভাবলাম গোড়ার কথাগুলো লিখলে কেমন হয়। তাই এই লেখা। কেমন লাগল জানাতে ভুলবেন না। সাথে আপনার গল্পও করুন না আমার সাথে। খুব ভালো লাগবে তা হলে।

আমাদের ছোটলাইন চলত আঁকেবাঁকে …

ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হওয়াটাই তো জগতের নিয়ম। এই সেদিনের সব কচি কচি ছেলেপুলে কিরকম গটগটিয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে দেখতে বেশ লাগে। তবে বড় হওয়ার পর অন্তত নিজের ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, ধুস্‌ বড় না হলেই হত। বড় হওয়া মানে আরো মেকি হওয়া। বড় হওয়ার এই পাপবিদ্ধ অনুভূতিটা থেকে একটু রেহাই মেলে কয়েকটা জিনিসে। যেমন শচীন তেন্ডুলকর, রোনাল্ডো (ব্রাজিলের), সুমন বা নচিকেতা। কিরকম? এই যেমন শচীন সাদা পোশাকে হাঁটু মুড়ে একটা কভার ড্রাইভ মেরে যখন নিজেই অ্যাপ্রিশিয়েট করে তখন আজও সেই ছোটবেলার আনন্দটা খুঁজে পাই। বা যখন বড় হতে হতে হাঁপিয়ে যাই, সেই মুহূর্তে যদি কোনভাবে ‘লাল ফিতে সাদা মোজা’ বা ‘এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু’ কানে আসে, বয়সটা ঝট করে একটু কমে যায়। শচীন যেদিন পুরোপুরি অবসর নেবে আমি শিওর আমার মধ্যে ধুকধুক করে টিকে থাকা স্বল্পপরিমান শৈশবটুকুও আমায় নিদারুন ভাবে টা-টা করবে। যেমনভাবে আমি অনেকটা খুইয়েছি, যেদিন থেকে সুমন বা নচি রাজনীতি করতে গেলেন। এতো সেই ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ খ্যাত প্রতিবাদী ভাবমূর্তি-ওয়ালা কালচারক্লিষ্ট প্রমোদ প্রধান হয়ে গেল ভাই। যাকগে যাক, আসল কথায় আসি। আমার ছোটবেলার আর এক সঙ্গী, ছোটলাইন হঠাৎ করে বড় হতে লেগেছে। না মানে, ঠিক হঠাৎ করে নয়, ভূমিষ্ঠ হওয়ার ৯৬ বছর পর।

ছোট থেকেই ছোটলাইন নিয়ে কেমন একটা হীনমন্যতা কাজ করত। পিসি-মাসীর ছেলেরা যখন বড়লাইনে এমনকি ইলেকট্রিক ট্রেন এ চড়ছে আমায় তখন ছোটলাইন ধ্যাড়াতে হচ্ছে। মামার বাড়ী লাভপুর, হ্যাঁ তারাশঙ্কর বাঁড়ুজ্জে খ্যাত লাভপুরের কথাই বলছি। ভদ্রলোকের উল্লেখ থেকেই আন্দাজ করতে পারছেন বোধ হয় ম্যাকলিয়ড কোম্পানী এই লাইন পেতে এবং লাভপুরকে এর মধ্যে স্থান দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যের কি অশেষ উপকারটাই না করে গেছেন। ‘কালো যদি মন্দ তবে, কেশ পাকিলে কান্দ কেনে’ বা ‘জীবন এত ছোট কেনে’-র মত অমর লাইন সৃষ্টি হওয়ার পিছনে এই ছোটলাইনের অবদান তো কম নয়। ঠ্যাঙাড়ে-লেঠেল বংশের ছেলে নিতাই কবিয়ালের আদত পেশা কিন্তু ছিল লাভপুর ষ্টেশনের কুলিগিরি।

বাড়ি আর মামার বাড়ি যেহেতু ছোটলাইনই জুড়েছিল তাই মামার বাড়ি যেতে ছোটলাইন একটা বড় ভরসা ছিল বইকি। তার সাথে আমার ছোটবেলায় আমার আর মা-এর, দুজনেরই বাসে বমি হওয়ার একটা বদভ্যাস ছিলই। সেইজন্যও মা সবসময়ই ট্রেনটাই প্রেফার করত, আর তাই আমরাও চোখে কয়লার গুঁড়ো খেতে খেতে স্টীম ইঞ্জিনের ছোটলাইনে চড়ে বসতাম। ঘন্টায় মাত্র ১৫-২০ কিমি গতিবেগে গরুরগাড়িকেও লজ্জা দেওয়া এই ট্রেনের অতি জনপ্রিয়তার একটা মূল কারন ছিল ‘ফ্রি রাইড’।iআজ্ঞে হ্যাঁ, বিনা টিকিটে ভ্রমণ। যাত্রী সাধারনের টিকিট কাটতে যতটা  আপত্তি, টিকিটবাবুরও টিকিট ঘাঁটাঘাঁটি করতে ঠিক ততটাই আপত্তি। কাজেই লোকমুখে এ হয়ে গেল ‘মামার গাড়ি’।iঅবিশ্যি গাড়ি তার ‘ভাইদের’ হলেও, মামার বাড়ি যেতে মা টিকিট কাটত না এরকমটা ভেবে বসলে কিন্তু বেজায় ভুল করবেন। একবার তো এমনও হয়েছে লাভপুর থেকে ফেরার সময়, স্টেশনমাস্টার কাম টিকিটবাবু কীর্ণাহারের টিকিট অনেকক্ষন ধরে খুঁজে না পাওয়ায় ট্রেনচালক অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কারন টিকিট দিয়েটিয়ে আমাদের ট্রেনে উঠিয়ে তবে উনি পতাকা নেড়েছিলেন। মনে রাখবেন এই লাইনের কোনো ষ্টেশনই কোনদিন কম্পিউটার দেখে নি। সেই আদ্যিকালের পিচ্‌বোর্ডের চৌকো চৌকো টিকিট। কাজেই খুঁজে না পেলে আর কি করা, সেধে আসা হাতের লক্ষ্মী তো আর পায়ে ঠেলতে পারেন না।

ছোটলাইন

ছোটলাইন
(উৎস – ইন্টারনেট)

বড় হচ্ছে

বড় হচ্ছে
(উৎস/সৌজন্যে – তরুন দত্ত (ফেসবুক))

এইসব পড়ে অর্থনীতিবিদরা যতই ভারতীয় রেলের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যহানি বা দেশের জি.ডি.পি. কমে-টমে যাওয়ার আশঙ্কায় চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে পড়ুন আমি কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতিতে ছোটলাইনের একটা অদ্ভুত অবদানের কথা বলব। এটা কিন্তু ঐ ষ্টেশনে চায়ের দোকান বা ট্রেনে হকারের বিক্রি বেশী এইসব ক্লিশের বাইরে – অ্যাডিশনাল। রবিদাদুর পৌষমেলা ভাঙতে না ভাঙতেই বীরভূম-বর্ধমান জুড়ে একটার পর একটা মেলা চলতেই থাকত। ‘থাকত’ কেন, এখনও ‘থাকে’।iবিক্রেতার দল মোটের ওপর কনস্ট্যান্ট থাকলেও ক্রেতারা স্থানীয়। ফুল্লরা তলা, জপেশ্বর তলা, বোরীগ তলা (বৈরাগী তলা) এরকম হাজারো সব মেলা। এদের মধ্যে বেশ কিছু মেলা বসে রেললাইনের আশেপাশে। লোকজনের যাওয়া-আসার সুবিধা, এই আরকি। এদের মধ্যে জপেশ্বরতলার মেলাখানা কীর্ণাহারের সবথেকে কাছে – ষ্টেশন থেকে রেললাইন ধরে ২-২.৫ কিলোমিটার। শিবরাত্রির এই মেলার সময় পুন্যার্থীদের অবশ্য ২-২.৫ কিমি হাঁটার কষ্টটা করতে হত না। ফর্মালি কোনো ষ্টেশন না থাকলেও ড্রাইভার সাহেব ট্রেনটিকে সেখানে দাঁড় করিয়ে পূন্যার্থীদের ওঠানামা শেষ হলে তবেই পরের ষ্টেশনের দিকে রওনা দিতেন। এখন আপনিই বলুন এই সুবিধাটুকু হওয়াতে মেলার জিলিপি, পাপড়ভাজা, প্লাস্টিকের পুতুল আর কাঁচের চুড়ির বিক্রি কি একটু হলেও বাড়ত না?

ছোটবেলায় মা-কাকীমার হাত ধরে মেলায় গেলেও একটু লায়েক হতেই ট্রেন ছেড়ে বন্ধুদের সাথে হেঁটে মেলা যাওয়াটাই দস্তুর হল। এইবেলা একটা কথা বলে রাখি। আমি ‘জপেশ্বর’ তলা বলছি বটে তবে লোকমুখে কিন্তু জায়গাটা ‘জম্পেশ্বর’ তলা নামেই বেশী পরিচিত। গ্রামাটিক্যালি ভুল হলেও ‘জম্পেশ্বর’-এর মধ্যে গ্রাম্ভারি ভাবটা বেশি থাকার দরুনই হবে হয়ত, ভোলেবাবার থানটির এই নামটিই বেশী প্রচলিত। সে যাই হোক, হেঁটে যেতে হলেও রেললাইন ধরেই যেতে হত। এবং এইখানেই ছিল সেই ভয়ের ব্যাপার। কি সেটা? একটা সাঁকো! মাটি থেকে ফুট পনেরো উঁচু আর গোটাগুটি ফুট কুড়ি লম্বা। আয়হীন এই পথে সাঁকো-টাঁকো বিশেষ সুবিধার হত না। মানসচক্ষে রেলসেতুর ছবি কিছু এসে থাকলে সেখান থেকে প্রথমেই রেললাইনের মধ্যের পাথরগুলো সরিয়ে দিন। এই রেলের লাইনে পাথর থাকার বদনাম কেউ কোনদিন দেয়নি। রেলিং-টেলিং তো দূর অস্ত। এবার রেল সাঁকোর সিমেন্টের বেসটা কল্পনা থেকে হটিয়ে দিন। শুধু দুটো লোহার গার্ডারের ওপর রেললাইনদুটো বসানো আর তাদের ধরে আছে কিছু স্লিপার। এবার আপনি সাঁকোর ওপর উঠুন। কয়েক পা স্লিপারের ওপর চলুন। নিচে তাকান। কি দেখলেন? পনেরো ফুট নিচে হয় জলকাদা না হয় শুকনো মাটি। আপনি কি করতেন জানিনা আমি যা করতাম সেটা হল বাবা ‘জম্পেশ্বরের’ নাম করে ঐ কয়েকটা স্টেপ পিছিয়ে এসে, নিচে নেমে শুকনো মাটি বা জলকাদা পেরিয়ে ওপারে গিয়ে আবার উঠে পড়া। তলা দিয়ে যেতে যেতে অবশ্যই সাহসী বন্ধুদের টিটকিরিটা সহ্য করতে হত। বড়লাইন হলে এই সাঁকোটা হয়ত অভিজাত হয়ে যাবে, সিমেন্ট আর পাথরের আস্তরনে ঢাকা পরবে ফাঁকগুলো। আর আমার চোখ তখন খুঁজে বেড়াবে মাথা-নিচু আর কান বন্ধ করে সেতুর তলা দিয়ে সেতু পেরোতে চাওয়া সেই ভীতু ছেলেটাকে।

আমার এইরকম অনেক ছোট ছোট বড় হওয়ার সাক্ষী এই ছোটলাইন। বাবা-মা-কাকা-দাদা ছাড়া গোটাগুটি একদম একা কীর্ণাহারের বাইরে যাওয়া এই ছোটলাইনে চড়েই। ক্লাশ সিক্সের হাফ্‌প্যান্ট পড়া, কদমছাঁট চুলের একটা ছেলেকে তার মা ছেড়েছিল ১০ কিমি দূরে টিউশনি যাওয়ার জন্য, তা সে এই ছোটলাইনেরই ভরসায়। সেখানেই একদিন সে অবাক চোখে দেখেছিল অতি পরিচিত শান্ত, সুশীল পাড়ার দাদাটিকে ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাতে। সে নিজেও কি আর এক-আধটা … বড় হওয়ার এই ছোট্ট সাথীটির বড় হতে একটু বেশীই সময় লেগে গেলো এই যা।

পুরানো সেই দিনের কথা।

পুরানো সেই দিনের কথা।
(উৎস/সৌজন্যে – সমিত রায়চৌধুরী)

কাকাবাবু হেরে গেলেন।।

ছেলেবেলায় যে দুটো কবিতা বলতে না পেরে নিজেকে বেশ বড়সড় একটা দুচ্ছাই মনে হত, তার একটা হল ‘কেউ কথা রাখেনি’। ১৫ই আগস্ট বা ২৬-শে জানুয়ারি বা অন্য কোনো তিথিতে ছোটোদের জন্য বরাদ্দ ‘বীরপুরুষ’ বা ‘পূজারিণী’ আবৃত্তি করে এসে যখন দেখতাম একটু বড়রা গলা কাঁপিয়ে বোষ্টুমি, নাদের আলী বা বরুণার কথা না রাখার কথা পারছে, তখন, সত্যি বলছি, আমারও ঐ না দেখা নাদের আলীকে বলতে ইচ্ছে করত, ‘আমি আর কত বড় হবো’? সুনীলবাবুর কবিতার সঙ্গে পরিচয়টা অবশ্য খুব বেশিদূর এগোয়নি আর। দোষ আমারই। আধুনিক কবিতার আধুনিকতার জালে হাঁসফাঁস করতাম সবসময়ই।

অবশ্য তার আগেই, ওনার গদ্যের সাথে ভাব হয়ে গেছে। সৌজন্যে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা। কাকাবাবুকে ভয় পেতাম, সন্তুকে পেছনপাকা লাগত আর জোজো ছিল একদম কাছের মানুষ – বম্বাস্টিক গুল মারা আর বেজায় খানেওয়ালা দুটো কারনেই। পূজোবার্ষিকীটা পেয়ে প্রথমেই যেটা খুলতাম সেটা কাকাবাবু, এমনকি সূচীপত্রেরও আগে। আজও যেকোনো পূজাবার্ষিকী পেলেই প্রথমে যেটা খুলি সেটা হল সুনীল গাঙ্গুলীর লেখা। আর সেটা হবে না।

তখন গরমের ছুটি। পশ্চিমবঙ্গের এক নামীদামী কলেজে ১১ ক্লাসে অঙ্কে সদ্য ফেল করেছি। অঙ্কের গিঁটকিরি খোলার জন্য স্ব-আরোপিত বন্দিদশা চালাচ্ছি। ছুটিতে বাড়ি না গিয়ে কলকাতায় মাসীর বাড়িতে থেকে টিউশনে যাচ্ছি আর অঙ্ক নিয়ে লড়ছি। মেসোমশাই অফিসের লাইব্রেরী থেকে একদিন একটা বই নিয়ে এলেন। বেশ মোটা, ওপরটা নীল রঙের প্রচ্ছদ, গঙ্গার ঘাটের ছবি, বাঁধানো চাতালে এক বাবু আর বিবি বসে আছে। অঙ্কে বোর হয়ে একদিন দুপুরে হাতের কাছে বইটা পেয়ে একটু নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম। প্রথম পাতা থেকেই মন ফেরাতে পারলাম না। তখনো জানিনা এটা দ্বিতীয় খন্ড। কিছুটা পড়ে কি মনে হওয়ায় খেয়াল করলাম সেটা। নাহ্‌, এ বই তো প্রথম থেকে না পড়লে চলছে না। লজ্জার মাথা খেয়ে মেসোমশাইকে বলেই ফেললাম, ‘একটু ‘প্রথম আলোর’ ফার্স্ট পার্টটা এনে দিতে পারবে?’ মেসোমশাই মুঁচকি হাসলেন যেন। ভাবলেন এ ছেলের অঙ্ক শেখা হয়েছে আরকি। আর অঙ্ক! যাকে ‘প্রথম আলো’তে ধরেছে তার কিবা অঙ্ক, কিবা ফিজিক্স। বইটা পড়ি আর ভাবি, এরকমও লেখা সম্ভব! নবজাগরণ-টণ নিয়ে তো আগেও পরেছি প্রচুর। সবই ইতিহাস বই – একটু ভারী। আর এ তো গল্পকথা। এত সহজ তাহলে নবজাগরণ ব্যাপারটা? আর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে যে লোকে বলে শক্তি-সুনীলেরা রবীন্দ্রবিদ্বেষী! বরং অনেক তথাকথিত রাবীন্দ্রিকের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের আত্তীকরণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এ বেশী। বিমল মিত্রের পরই আমি ঔপন্যাসিক হিসেবে সুনীল গাঙ্গুলীকে বসিয়ে ফেললাম, আমার কাছে। এই অবাক ভালোলাগা পরে পরে আরো বাড়িয়ে দিল ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’।iএবং প্রত্যেকটা উপন্যাসই পড়তে পড়তে এটাই মনে হত, এরকমও লেখা যায়!

পরে পরে অনেক ক্ষেত্রে তার মতের সাথে আমার মত মেলেনি। কিন্তু সেসবের সাথে সত্যিই কি তার লেখনীর কোনো সম্পর্ক আছে? তার লেখা তার যায়গায় আর তার মত তার যায়গায়। ভালোবেসেছি তার লেখাকে, কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তিনি নিজের জীবন নিজের মত করেই বেঁচেছেন। মতামত যা ছিল স্পষ্ট। সে তার কিছু কিছু কার্যক্রম কারো কারো ভালো লাগুক চাই না লাগুক। ধরি মাছ না ছুই পানি – এ জিনিস তার মধ্যে ছিল না। একজন সামান্য আঞ্চলিক সাহিত্যের লেখক – কিন্তু মৃত্যুকালেও তার ক্যারিশ্‌মার জোরে লাল-নীল-সবুজ সব এক হয়ে গেলো। হতে পারে তার পিছনে আছে রাজার নীতির জটিল-কুটিল অঙ্ক, কিন্তু শেষপর্যন্ত মেলালেন তো তিনি! অতএব, আমার অঙ্কের সাধনা গুলিয়ে দেওয়া হে কাকাবাবু, আদতে কিন্তু আপনি হারেননি, কাকাবাবু যে হারতে পারেন না।।

উৎসঃ গুগ্‌ল ইমেজেস্‌।

পুনশ্চঃ ছোটবেলার অপর শিহরণসৃষ্টিকারী কবিতাটি ছিল – ‘প্রিয়তমাসু’ – শ্রী সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা।

যাত্রাপথ।।

যাত্রা আপনারা কয়জন দেখেছেন বা আদৌ দেখবার ইচ্ছা রাখেন জানিনা, আমার কিন্তু যাত্রা ব্যাপারটা বেশ লাগে। পুরো প্যাকেজটাই অসাধারণ। শুরু হয় পোস্টার দিয়ে। ওয়ান ফাইন মর্ণিং, চোখে পড়বে, বাংলা-হিন্দী সিনেমা, গুপ্তরোগ বা বিশ্ববিখ্যাত সার্কাস এরকম হাজার কিসিমের পোস্টারের ভিড় সামলে উঁকি দিচ্ছে পৈশাচিক হাঁসি নিয়ে ক্রুর ভিলেন বা সুন্দরী নায়িকার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা বাবরি চুলের নায়ক। পোস্টারের লে-আউটটা মোটামুটি এরকম –

১. টপ-রাইট – হয় ভিলেন না হয় নায়ক-নায়িকার (ডিপেন্ড করছে কে বেশি বিখ্যাত তার ওপর) বড়সড় ছবি।
২. মাঝখান – (ঢেউখেলান ফন্টে) অমুক অপেরা (যেমন, জগৎজয়ী বা মুক্তমঞ্জরী) নিবেদিত এবছরের সর্বশ্রেষ্ঠ সামাজিক/ঐতিহাসিক/পৌরাণিক যাত্রাপালা তমুক (যেমন মীরার বঁধূয়া বা রোগা স্বামীর দারোগা বউ বা শ্বাশুড়ী বিশ্বসুন্দরী)।
৩. বটম-লেফট – ভিলেন বা নায়ক-নায়িকার মধ্যে যার স্থান টপ-রাইটে হয়নি তার বা তাদের ছবি। সঙ্গে আর দুএকজন স্বল্পনামী কুশীলবের ছবিও থাকতে পারে। তার ডানদিকে যাত্রার স্থান-কাল ও প্রবেশমূল্য। টিকিটের দামটা নির্ভর করত আপনি ‘জমিনে’ বসতে চান না ‘চেয়ারে’ তার ওপর, আর টিকিট  ‘অগ্রিম’ কাটবেন না যাত্রার দিন ‘কাউন্টারে’ কাটবেন তার ওপর।
৪. টপ-লেফট এ সাধারণত যাত্রা যারা আয়োজন করছে তাদের নাম থাকত। যেমন ধরুন, ‘কীর্ণাহার তরুন সমিতির সপ্তম বর্ষের নিবেদন … ’ ইত্যাদি। এখানে একটা অপশনাল পার্টও ছিল। সেটা জাহির করার চেষ্টা করত যাত্রাপালাটি সংগঠিত করার পিছনের মহৎ কারণটি। সেটা ‘এলাকাবাসীর সাহায্যার্থে নতুন অ্যাম্বুলেন্স ক্রয় প্রকল্প’ও হতে পারে আবার ‘গ্রামের সুপ্রাচীন মনসা-মন্দিরটির পুনরুজ্জীবন প্রকল্প’ও হতে পারে।
৫. এছাড়াও পোস্টারের টপ ও বটম মার্জিনের জায়গাদুটিতেও কয়েকটি কথা লেখা থাকত যেগুলো মোটামুটি সব যাত্রার পোস্টারেই থাকত এবং দু একটি শব্দ ছাড়া বিশেষ চেঞ্জও হত না। উপরেরটায় লেখা থাকত – ‘আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ। এক (বা দুই) রাত্রিব্যাপী বিরাট যাত্রানুষ্ঠান’।iআর নিচেরটায় লেখা থাকত – ১. অগ্রিম টিকিটের উপর লটারির মাধ্যমে ১৫ টি দেওয়াল ঘড়ি (বা ২টি সাইকেল) পুরস্কার থাকিবে। ২. যাতায়াতের জন্য বাসের সুব্যাবস্থা থাকিবে। ইনভেরিয়েবলি, সাধুভাষায় এই কথাকটি লেখা থাকার জন্য আমার মনে হত, এই মার্জিনটা বোধহয় তৈরিই থাকে, যাত্রার নাম-টাম গুলো পরে  অর্ডার অনুয়ারী বসানো হয়।

এতো গেল প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচার। এবারে আসুন শব্দব্রহ্মের প্রয়োগে। মূল যাত্রানুষ্ঠানের মাস-দুয়েক (ইয়েস ২ মাস) আগে হঠাৎ কোনদিন শুনতে পাব, (কিঞ্চিৎ ক্যাঁ কো জাতীয় মাইক্রোফোনোচিত আওয়াজের পর) “বন্ধুগন, বন্ধুগন, বন্ধুগন (বান্ধবীদের কেন উদ্দেশ্য করা হয়না কে জানে) আর মাত্র কয়েকদিন পর, আআর মাত্র কয়েকদিন পর কীর্ণাহার K.S.A. ময়দান মাতাতে আসছে গ্রাম-বাংলা-শহর-বাজার তোলপাড় করা যাত্রাপালা …”।iএরপর যাত্রার ক্যাসেট থেকে একটু চড়া গলার সংলাপ, সাথে ঝ্যাঁকোর-ঝ্যাঁকোর আওয়াজ। তারপর আবার – “সেসঠাংসে (শ্রেষ্ঠাংশে) রয়েছেন যাত্রাজগতের মহানায়ক সামথিং কুমার, তার সাথে রয়েছেন টলিউড-বলিউডের দুষ্টুমিষ্টি নায়িকা মিস্‌ সামওয়ান …”।iমাঝে মাঝে শুধুই “আর মাত্র কয়েকদিন পর, আআর মাত্র কয়েকদিন পর” বলে থেমে যাওয়া। অবিশ্যি, মাঝে মাঝে দু-একটা কাজের কথাও কানে চলে আসে। যেমন – “এই বিড়িটা কে নিলি রে?” বা “এই এখন জ্বালাস না মাইরি” ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর মোটামুটি যাত্রার মাসখানেক আগে থেকে শুরু হয়ে যায় চলমান গাড়িতে প্রচারাভিযান। একটা লঝ্‌ঝরে ম্যাটাডোরের চারিদিকে ছোটবড় হাজার কিসিমের পোস্টার লাগানো থাকে। আর তার সাথে ছাদের দুদিকে দুটো চোঙা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ে কয়েকজন। বুলি মোটামুটি একইরকম থাকে, তবে তার সাথে এই কথাগুলো আরও যোগ হয় – “আমাদের প্রচারগাড়ী আর কিছুক্ষণের মধ্যে আপনাদের অ্যালাকা ছেড়ে সামনে এগিয়ে যাবে, আপনারা তাড়াতাড়ি নিজ নিজ টিকিট সংগ্রহ করে নিন”।

উৎসঃ ইন্টারনেট – চিনতে পারেন? ইনি মহামহিম বুশ্‌। উনি অবশ্য হাতে আংটি পড়তেন কিনা জানিনা।

এইভাবে একদিন ‘দ্য ডে’ এসে পড়ে। অবশ্য তার দুদিন আগে থেকেই আমাদের খেলাধূলো বন্ধ হয়ে যেত। এর দুটো কারন ছিল। প্রথমটা মাঠের আয়তন কমে যাওয়া। মানে, যে বিশাল K.S.A. (Kirnahar Sports Association) এর মাঠে আমরা সমেত কম করে ৫-টা দল খেলাধূলো করতাম সেটারই অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ টিনে ঘেরা পড়তো। আর দ্বিতীয় কারনটা ছিল, এইকটা দিন ছেলেপিলে টিনের বাইরের থেকে টিনের ভেতরের যায়গাটার প্রতিই বেশি আকর্ষণ বোধ করত। স্টেজ কোথায় হচ্ছে, কত উঁচু, সবাই দেখতে পাবে তো, ঐতো স্টেজে ওঠার সিঁড়ি, তার মানে ওইখানে গ্রিনরুম হবে, এরকম হাজারো সওয়াল-জবাব চলতে থাকে মনের মধ্যে। তখন কিবা ক্রিকেট, কিবা ফুটবল, কিবা পিট্টু।

যাই হোক, যাত্রার দিন তো, ‘আর মাত্র কয়েক ঘন্টা, আআর মাত্র কয়েক ঘন্টা’ শুনে সাতসকালে ঘুম ভাঙ্গে। বাড়ির পড়া তো মার গোলি, কিন্তু ইস্কুল? সে তো ছাড়ান নেই, মনের কষ্ট মনেই চেপে রেখে যেতাম স্কুল। সেদিনের যাওয়াটা যেন, ট্র্যাজিক সিনেমার শেষটুকুর মত। সবাই চলতে হয় চলেছে, মন-টন নেই কারোর। যেতে যেতে আবার দেখতাম প্রাইমারী স্কুলে ছুটি। আরে ছুটি হবে না-ই বা কেন? ওটাই তো যাত্রাপার্টির ঘাঁটি। স্কুলের পাঁচিলের ধারে দুটো ইয়াব্বড়ো উনুনে হাঁউমাউ আগুন, আর তার ওপর প্রমান সাইজের দুটো কড়াই। উফ্‌ফ, এইসব ফেলে ইস্কুল! পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর কেন? কোন কোন বার দেখেছি প্রাইমারী স্কুলের পাশের মাঠে বড়সড় একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে বেশকিছু অনামী কুশীলব হাজির। নামী-দামীরা এখন বোলপুরে ভালো জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছেন। তারা ঠিক ফার্স্ট সিনের আগে গাড়ি করে এসে, হয় ধাঁ করে স্টেজে (যদি মেকাপ হয়ে গিয়ে থাকে) না হয় গ্রীণরুমে (উল্টোটা হলে)।iএই অনামীদের মাঝে-সাঝে দেখেও ফেলেছি, হয়তো কেউ লুঙ্গি, স্যন্ডো পড়ে আর কোমরে গামছা জরিয়ে দাঁতন করছেন। কাল রাত্রে শো-এর পর মেদিনীপুর বা মালদা থেকে ওভারনাইট বাসে আসা তো, কাজেই একটু পরিষ্কার হয়ে নেওয়া দরকার। ফ্রেশ হয়ে এখন একটু ঘুমোতে না পেলে রাত্তিরে টানতে পারবেন না তো। তাদের থাকা-খাওয়া তো বুঝতেই পারছেন প্রাইমারী স্কুলে ব্যবস্থা করা হয়েছে। কখনও যদি স্কুলের পথে এসবের দেখা নাও পেতাম, স্কুলে কি করে জানিনা, ঠিক আপ-টু-ডেট খবরাখবর পেয়ে যেতাম। তবে হ্যাঁ শিবচন্দ্র হাইস্কুল সেদিন বেশিক্ষণ আঁটকে রাখতো না, তাড়াতাড়ি চলে আসতাম বাড়ি।

তড়িঘড়ি নাকে-মুখে কিছু গুঁজে দে ছুট মাঠের দিকে। আজ খেলা তো দূরের কথা, ব্যাট-বলই বেরোয় না। দ্রুত প্যান্ডেলের মধ্যে ঢুকে দেখি, অলরেডি অনেকেই হাজির হয়ে গেছে। অনেকেই, বলতে খেলার সঙ্গীরা। চেটেপুটে উপভোগ করে নেওয়া আরকি, ফিনিশিং টাচ্‌টা। ক্লাবের দাদাদের তাড়া খেয়ে বেরিয়ে আসার আগে শেষবারের মত দেখে নিতাম বিশাল কিন্তু ফাঁকা স্টেজ আর ঘিরে ফেলা মাঠটা। সেখান থেকে বেড়িয়ে সোজা বাড়ি। বাড়ির কাছে তখন হৈ-হৈ কাণ্ড রৈ-রৈ ব্যাপার। ‘যাতায়াতের সুব্যবস্থা’কারী বাসগুলো একে একে আসতে শুরু করেছে। মাইকে অহরহ তার ঘোষণা – ‘লাভপুর-মৌগাঁ-বাকুল-গোমাই থেকে আসা মা জগদ্ধাত্রীর ড্রাইভারকে বলা হচ্ছে বাসটা একটু এগিয়ে দাঁড় করাতে।’ কাকস্য পরিবেদনা। ছাদে-বাম্পারে থাকা বাস থেকে জনতা তখন নামতে লেগেছে। কাজেই বাস নট নড়ন-চড়ন। এদিকে পিছনে ‘নতুনগ্রাম-ফুটিসাঁকো-কালকেপুর-দাসকলগ্রাম’ থেকে আসা ‘পারভেজ’ এন্তার হর্ণ বাজিয়ে যাচ্ছে। সে সুবিধামত জায়গা পায়নি লোক নামানোর। সবমিলিয়ে সন্ধ্যেটার একটা জমাটি শুরু।

এরপরের পর্বটা খোদ আমাদের বাড়িতেই। অবস্থানগত একটা বিশাল সুবিধা আছে আমাদের বাড়ির। বাসস্টপ থেকে যাত্রার মাঠে যাওয়ার রাস্তার ঠিক মুখেই আমাদের বাড়ি। আর বাড়ির সামনের দিকে আমার বাবার দোকান। সবমিলিয়ে যাত্রার ‘ওয়ান অফ্‌ দ্য টিকিট কাউন্টারস্‌’ হওয়ার একদম আইডিয়াল জায়গা। বাড়ি ফিরেই দেখতে পেতাম বাবা দোকান-টোকান গুটিয়ে ফেলেছে আর সামনের কোলাপসিবল্‌ গেটটা টেনে দিয়ে তার পিছনে সবুজ রঙের টিকিটের বান্ডিল আর টিনের বাক্সে কিছু রেজকি গুছিয়ে বসেছে ক্লাবের দায়িত্ববান লোকজন। রাস্তার উল্টোদিকে বিল্টুদের বাড়িতে বসত এরকমই আরেকটা কাউন্টার। টিকিট বিক্রি শুরু হলে এই দুই কাউন্টারের মধ্যে চোরা টেনশনটা দেখবার মত হতো। আমাদের চর শুধু বিল্টুদের টিকিট বিক্রির খবরই আনছে না, আমাদের খবরও যে ওপাড়ায় চলে যাচ্ছে সে খবরটাও চিন্তাক্লিষ্ট মুখে শোনাচ্ছে। যেন চর শুধু আমরাই লাগাব, ওদের চর ফিট করার অধিকার নেই! এমনকি রীতিমত খদ্দের ভাঙ্গাতেও দেখেছি একে অপরকে। অবশ্য টিকিট বিক্রি শেষ হলে এই রেষারেষির রেশমাত্র থাকত না। তখন সবার মুখে একই বান্ডিলের বিড়ি। আমার অবশ্য শেষের জন্য ওয়েট করলে চলবে না। বাহ্‌, বাড়ির ভিতরে দেখতে হবে না, প্রস্তুতি কতদূর। নিজেকেও তো রেডি হতে হবে।

অল্প কিছু খেয়ে নিয়ে, মাঙ্কি ক্যাপ ফুল সোয়েটার সমেত ‘I am ready’। মা-ঠাকুমা-কাকীমা সমেত গোটা দলকে আসরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসত টর্চ হাতে মেজকাকা। সঙ্গে থাকত লেবেঞ্চুস আর নাড়ু মোড়লের ডালমুট। সংখ্যাগরিষ্ঠের মত ‘জমিন’-এই বসতাম। দাম বেশি হলেও চেয়ারটা ঠিক সুবিধেজনক অপশন ছিল না। পিছনে জমিনের দর্শকদের যাতে অসুবিধে না হয় তার জন্য চেয়ারগুলো বেশিরভাগ সময়ই স্টেজের সামনে না হয়ে পাশের দিকে হত। তাই চেয়ারে বসে ভালো করে দেখাও যেত না। মোদ্দা কথা চেয়ার মোটামুটি ফাঁকাই থাকত। যাই হোক, প্রথমে লটারী করে সাইকেল, ঘড়ি যা দেওয়ার দিয়ে দেওয়া হত। তারপর ক্লাবের পোর্টফোলিওরা ছোটখাট বক্তিমে শুরু করতেন। তবে দর্শক একটু বেশিমাত্রায় উশখুশ করে উঠলেই বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিতেন। তারপর গুনে গুনে তিনখানি ঘন্টা ও যাত্রাশুরু।

তারপর ঘন্টা-তিনেক কোথা দিয়ে কেটে যেত কে জানে। বেশি ছোটতে, যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে আমি ঠিক ঘুমিয়ে পড়তাম। এখন পাশের ঘরে কেউ জোরে কথা বললে ঘুম বলে আসব না, আর তখন ঐ ঝাঁই-ঝপ্পড়ের মধ্যেও কি করে ঘুমিয়ে পড়তাম কে জানে। হঠাৎ করে দর্শককুলের কোনো সমস্বর আওয়াজ (যেমনঃ- ‘ইস্‌স একদম মেরে ফেলল’) শুনে জেগে উঠে পরিস্থিতি বুঝবার চেষ্টা করতাম ঠিকই, কিন্তু দ্রুত রণে ভঙ্গ দিতাম। তবে এটুকু বুঝতে পারতাম, যে ঘুমটা বসে বসে শুরু হয়েছিল, সেটা বদলে গেছে। মাথাটা মায়ের কোলে, পায়ে একটা চাদর – এইসব আরকি। তারপর ঢুলে ঢুলে মাঝরাত্তিরে বাড়ি ফেরা। একটু বড় হওয়ার পর অবশ্য ঠিক ঘুমিয়ে পড়তাম না। তবে মূল যাত্রার থেকেও বেশী আশপাশটা দেখতে থাকতাম। হাজার হাজার বিড়ি কিরকম জ্বলছে-নিভছে, তাদের ধোঁয়া কিরকম প্যান্ডেলের ছাদে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে আর বেরোতে পারছে না, বিড়ির মালিকরা কিরকম ভদ্দরলোকের মত বসে যাত্রা দেখতে শুরু করেও টেনশনের মুহূর্তে বিড়ি হাতে উবু হয়ে বসে পড়ল, বা বিড়ির মালিকের বৌ কিরকম স্বামীকে লুকিয়ে আঁচল দিয়ে দু-ফোঁটা চোখের জল মুছে নিল, এইসব।

আমার যাত্রাপথ এবার শেষ করি। তবে আমি যে শুধু দর্শকই ছিলাম না, মাঝে-সাঝে ‘কুঁজোরও যে চিৎ হয়ে শোওয়ার সখ’ হয় সেটার প্রমাণ এই ছবি।

স্থান – কীর্ণাহার তরুন সমিতির স্টেজের পিছন, কাল- আমি তখন ক্লাস ফাইভ – পূজোর সময় ক্লাবের ছেলেরা মিলে যে যাত্রা করত সেরকমই একটা যাত্রায়, পাত্র – নটসূর্য আবিরকুমার উরফ্‌ ‘রক্তে রাঙা মাটি’ যাত্রার রাজপুত্র।

শীতের আগের শীত

পূজো তো এসেই গেল। চলেও যাবে। যাওয়া-আসার এই হাসি-কান্না ভরা কিস্‌সা তোলা থাকল আরেকদিনের জন্য। আজ বরং যাওয়ার পরের গল্পটাই করি একটু আপনাদের সাথে।

দুঃখু দুঃখু ভাবের সাথে শীতের নিশ্চয় একটা নিবিড় সম্পক্কো আছে। ছোটবেলায় মা দুগ্‌গা কৈলাশে ফিরে যাওয়ার পর প্রত্যেকটি দিন সকালবেলা ঘুম ভাঙার সাথে সাথে যখনই মনে হত, ধুস্‌ আবার ক-অ-বে পূজো আসবে, তখনই যেন একটু শীত শীত করে উঠত গা হাত পা। আরেকটু কুঁকড়ে-মুকড়ে শুয়ে পড়তাম আবার। এইভাবে চলতে চলতে কালী-ঠাকুরও (নাকি ঠাকরুণ) একদিন ফাঁকি দিয়ে চলে যেতেন। প্রথাগত উৎসবের মরশুম শেষ। দুঃখু দুঃখু ভাবও বেশি মনে। আর তাই বেশি শীত।

যদিও শীত আমার প্রিয় ঋতু, শীতের আগের প্রি-শীতটাও ফ্যালনা নয়। বর্ষার উচ্ছলতা আর শীতের গুরুগম্ভীর ভাবুকতাকে মেলাত এই অমোঘ হেমন্ত। দুদিন আগে যে সময় রোদ্দুরের প্রবল প্রতাপ উপেক্ষা করা যেত না, এখন সেসময় সন্ধ্যে নেমে গেছে। কিরকম একটা মনে করিয়ে দেওয়া যেন – এই আছে এই নেই। সাধে কি জীবনানন্দের কবিতায় বারবার ঘুরে ঘুরে আসে ‘কার্তিকের নীল কুয়াশা’? অনেককিছু মনে পরছে আজ।  ধোঁয়াশায় মুখ ঢেকে বিকেলগুলো দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া শুরু করত। মাঠ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে না আসতে ইচ্ছে করলেও ফিরে আসতে হত, কারন হঠাৎ একটু শীত-শীত করে উঠত যেন গা-হাত। পরীক্ষা-টরীক্ষা সব শেষ। একটা চাপহীন সময়। রাত্রে চাদর বা কাঁথায় সেঁধনোর আগে বার তিনেক পড়া সেবারের পুজাবার্ষিকীটা নিতে ভুল হতো না। সন্তু, জোজো বা অর্জুনের সাথে গল্প করতে করতে ঘুম নেমে আসত চোখে।

উৎসঃ ইন্টারনেট

ঘুমোবার আগে চোখ চলে যেত সামনের বাড়ির আকাশ-প্রদীপটার ওপর। যদিও ‘জিরো ওয়াট’ বাল্ব দিয়ে বানানো, নড়াচড়া করার কথা না, তবু সেসময় মনে হত, কুয়াশা মাখা আকাশ-প্রদীপ যেন অল্প অল্প দুলছে। ঘুমিয়ে পড়তাম। ভোরের দিকে ঘুম ভেঙ্গে যেত মোটা গলায় ভেসে আসা অল্প সুর মেশানো কোন চিৎকার শুনে। গ্রামের শেষপ্রান্তে থাকা আখড়ার গোস্বামীটি বেড়িয়ে পরেছেন, কার্ত্তিক মাসের রীতি অনুয়ারী কীর্তনে। চোখ খুলে প্রথমেই দেখতে পেতাম সেই আকাশ প্রদীপটি। এখন একটু ছোটো হয়ে গেছে, কুয়াশার প্রকোপে। কাঁথাটা মাথা অব্দি টেনে নিয়ে গুটিশুটি মেরে আবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে দেখতাম মা কখন যেন ঠিক ১ বা ২-এ চলা ফ্যানটাকে বন্ধ করে দিয়ে কাঁথাটাকে ঠিক করে দিয়ে গেছে।

কার্তিক ফুরোতে না ফুরোতে স্কুল খুলে যেত। মনখারাপ নিয়ে স্কুলে গেলেও বহুদিন পর দূরের বন্ধুদের কাছে পেয়ে দুঃখ ভুলতে সময় লাগত না। পূজোর পাওয়া-না-পাওয়ার গল্পে কলকল করে উঠত স্কুলপ্রাঙ্গন। সে গল্প শেষ হতে না হতেই এসে যেত গোষ্ঠ-জগদ্ধাত্রী পূজো। এ আবার বাড়ির পূজো। ‘বড় ধূম লেগেছে হৃৎকমলে’।iরঙচঙ করা গরু-বাছুর, ততোধিক রংচঙে কাপড়-জামায় তাদের পালক-পালিকা আর ঢোল-ভেঁপুর আওয়াজ-এর কার্নিভাল – এই ছিল আমার গোষ্ঠ। এখন শুনি লাউড-স্পিকারের আওয়াজে ঢোল-ভেঁপু মাইনরিটি হয়ে গেছে। কাকুর আড়তের কর্মচারী ‘নারান দাদু’র কাঁধে চড়ে একদিনের (নাকি এক সন্ধ্যের) গোষ্ঠমেলা থেকে পাঁপড় কিনে খাওয়া। অবশ্যই আমাকে এতটাও নির্লজ্জ ভাববেন না, যে আমি হাইস্কুলে পড়তেও দাদুর কাঁধে চড়েছি। এটা নিতান্তই শিশু বয়সে। কিন্তু চোখ বুঁজলে এটাই মনে পড়ে যে, কি করব? আমাদের মত ছোটদের না ছিল পুরুষ মহলে পূজোর ব্যবস্থাপনায় নিজেদের মতামত ব্যক্ত করার অধিকার (দুনিয়াদারি আজই ভালো করে বুঝে উঠতে পারলাম না, তখন তো কোন ছাড়) আর না ছিল মহিলামহলে পূজোর আয়োজনে কোন অধিকার (আমরা নাকি সবসময় কি যা-তা ঘেঁটে-ঘুটে বেড়াচ্ছি – সব ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যাবে)।iসারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করতাম, পুষ্পাঞ্জলির সময় পুষ্পাঞ্জলি দিতাম আর খাওয়ার সময় হাত-টাত ধুয়ে চাতালে পাত পাড়তাম সবার সাথে। ভাগ্যের ফেরে যদি কোন রাশভারী দাদু বা জেঠু পাশে বসতেন তাহলেই হত আরকি। ‘কি রে সারাদিন ছোটাছুটি করলেই হবে? শুনলাম হাফ্‌ইয়ারলিতে নম্বর কমে গেছে।’ বলুন তো ক্ষিদে পেটে কাঁহাতক এইসব ভালো লাগে? অবশ্য পাশে যদি বহুদিন দেখা না হওয়া কোনো জেঠিমা বা কাকিমা বসতেন তাহলে এগুলোই বদলে যেত, ‘রঞ্জুকে আর দেখাই যায় না, আসিস না কেন রে আমাদের বাড়ি’ – এইসবে। মুখে ভাত ভরে হুঁ-হাঁ ইত্যাদি বলে নিজেকে ব্যাস্ত প্রমান করে দিতাম।

উৎসঃ ইন্টারনেট

জগদ্ধাত্রী পূজো মিটল তো নবান (ভাল বাঙলায় নবান্ন)। নবান মানেই কলাপাতায় নতুন চালের গলা গলা ভাত আর তার সাথে কম করে ১০-১২ রকমের ভাজা – আলু, পটল, বড়ি, নারকোল মায় আঁখ অব্দি ভাজা! সকালের দিকে চাল মাখা তো ছিলই। অবশ্য আরও সকালে আরো একটি কঠিন কাজ সারতে হত – স্নান। ভাবছেন এতে আবার কষ্ট কি? করে দেখুন তো শীতের মরশুমে প্রথম সকালবেলায় চান, তাহলে বুঝবেন। অবশ্য নবানের নেমতন্ন খেতে এত সকালে স্নান করতে হত না। এইভাবে নবান, পান্ত-নবান  করতে করতে এসে যেত জাঁকিয়ে শীত। একে একে বেরোত সোয়েটার, মাফলার, জ্যাকেট, লেপ, দস্তানা। নাহ, এখন আর পুরোদস্তুর শীতের গল্প নয়, আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। আপনারাও বরং একটু আপনাদের শীত-প্রি-শীত বিলাসিতার গল্প করুন না আমার সাথে।

অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন …

এবারের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকটি (লন্ডন ২০১২) নানাকারণে স্মরণীয় হয়ে থাকলো। উসেইন বোল্টের স্বপ্নের দৌড়, মাইকেল ফেল্পসের নিজেকে সর্বকালের অন্যতম সেরা সাঁতারু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, একটি অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি পদক জেতার ভারতীয় রেকর্ড, আভিজাত্য আর আধুনিকতার মিশেলে অনবদ্য এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান – সবকিছু মিলে সত্যিই ‘The Greatest Show on the Earth’। তা বলে ভেবে বসবেন না যে আমি খেলোয়াড়দের নৈপুণ্য নিয়ে আমার অল্পবিদ্যার ভান্ডার খুলে বসব। আমি আজ এমন একটা জিনিস নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি, যেটা নজরে হয়ত অনেকেরই পরেছে, কিন্তু ঘটনাটা দ্রুত মাথা থেকে চলেও গিয়েছে। আমিও সেই দোষে দোষী, তবে জিনিসটা আবার আমাদের চোখের সামনে এনে দেয় আনন্দবাজার পত্রিকার ২৭ শ্রাবণ, ১৪১৯ এর এই খবরটি

সত্যিই, যখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সব দেশের প্রতিযোগীরা এক এক করে নিজ নিজ দেশের পতাকা কাঁধে হেটে যাচ্ছেন হঠাৎ একটা অদ্ভুত ‘দেশ’ চোখে পড়ল – Independent Olympic Athletes।

Photo Credit: Richard Mackson-USA TODAY Sports

এরা আবার কারা রে ভাই? যাকগে পরে দেখা যাবে। পরেও হয়ত দেখতাম না, কিন্তু শ্রী ‘গুওর মারিয়াল’ (Guor Marial) এর অসামান্য জীবনকাহিনি এই ফিরে দেখাটাই ঘটিয়ে দিল। ভাবতে বসলাম কি করে একটা মানুষের কোনো ‘দেশ’ না থেকে পারে? কোথাও না কোথাও তো জন্মেছিলেন উনি। এখন জন্মভূমি মানেই দেশ কিনা সে তর্কে না গিয়ে যেটা জানলাম সেটা হলো উনি এইমুহূর্তে পৃথিবীর সবথেকে টাটকা দেশের নাগরিক। দেশটা ‘দক্ষিণ সুদান’।.প্রায় ৬০ বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের শেষে সবেমাত্র স্বাধীন দেশ (জুলাই, ২০১১) হিসেবে জন্ম নিয়েছে দেশটি।

এই গৃহযুদ্ধের শুরুটা ছিল আরেকটা দেশের স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত। কে বলেছে ব্রিটিশ সিংহ শুধু দেশ ভাগ করেই বিভিন্ন দেশের শান্তি বিঘ্নিত করেছে? দরকার পরলে দেশ জুড়ে দিয়েও যে ঝামেলা বাধানো যায় তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বোধহয় ‘সুদান’।. চলে যাওয়ার আগে এতদিনের উত্তর ও দক্ষিন সুদান কে এক করে দিয়ে গেল ব্রিটিশ শক্তি এবং অবশ্যই সেখানকার বাসিন্দাদের মত না নিয়েই। ১৯৫৩ সালে স্বাধীন হওয়া দেশটির উত্তর ও দক্ষিন ভাগের মধ্যে লেগে গেল যুদ্ধ, বছর দুয়েক না যেতে যেতেই। ১৭ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, লোকবল সবদিক থেকেই দুর্বল দক্ষিন সুদানে মারা গেল ৫ লক্ষ মানুষ, যার ৮০ শতাংশই ছিল নিরস্ত্র। ৭২ সালে যুদ্ধ থামল বটে তবে তা আরো বড় আকারে বেশিদিন চলার জন্য। এবার চলল ২২ বছর – ১৯৮৩-২০০৫।.আর মানুষ নিকেশের হিসেবটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি, তফাৎটা হল ওটা ছিল গোটা বিশ্বের হিসেব এটা মাত্র একটি দেশের।

এইরকম একটা সময়ে এ দেশে জন্মান গুওর। জন্মেই দেখলেন ‘ক্ষুব্ধ সুদানভূমি’।.দেখলেন শিশুরা এখানে খেলনা হিসেবে পায় বন্দুক। পুরস্কার হিসেবে পায় বুলেট, তিরস্কার হিসেবেও জোটে বুলেট, তবে শরীরের মধ্যে। দেখলেন মানুষের ঘর মানে রিফিউজি ক্যাম্প, পরদেশে তো বটেই নিজদেশেও। দুর্ভিক্ষ, অশিক্ষা, শিশুমৃত্যুই দস্তুর। আর কি দেখলেন? দেখলেন, প্রাণ বাঁচাতে হলে দৌড়তে হবে। অনেকের মত শিশু গুওরও অপহৃত হলেন এবং দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে গেলেন। কিন্তু যে ছেলে পরে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে ম্যরাথন দৌড়বেন তাকে কি কেউ আটকে রাখতে পারে? তিনি পেরেছিলেন পরিবারের কাছে ফিরতে। অনেকেই, না না, – কেউই পারে না। কিন্তু এলে কি হবে? সুদানের পুলিশ ছাড়ল না, বাচ্ছা ছেলেটিকেও। এমন মারল যে হাসপাতালে কাটাতে হল কয়েক সপ্তাহ। সেই বেরোলেন জন্মভূমি থেকে আজও ফিরতে পারেননি। তার আগে অবশ্য তাকে ভাইবোনদের মৃত্যু দেখতে হয়েছে। তারপর মিশর হয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারে এসে পারলেন একটু থিতু হতে।

এ ছেলে তো যথার্থই বলবে “দৌড় কি করে খেলা হয়”? দৌড় যে শুধুমাত্র খেলা হতে পারেনা, সেটা আমাদের দেখিয়েছিল ছোট্ট আলি আর জারা। কিন্তু সে তো সিনেমা। গুওর যে কঠিন বাস্তব, আর তাই আরও কঠোর। না হলে, কেউ কি করে এতকিছুর পরেও সুদানের হয়ে অলিম্পিকে নামতে বলে, যেহেতু তার দেশ দক্ষিণ সুদানে কোনো অলিম্পিক কমিটি নেই!! আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির এই প্রস্তাবে গুওর বলেন যে সুদানের হয়ে তিনি নামবেন না, নামলে সেটা হতাশাজনক ও অস্বস্তিকর হবে তার ও দক্ষিণ সুদানের হাজার হাজার সেইসব মানুষের পক্ষে যারা স্বাধীনতার জন্য মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাদের মধ্যে গুওরের ভাইও ছিলেন। কেউ কি করে এতটা ইনসেনসিটিভ হতে পারে কে জানে! শেষমেষ আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি তাদের পাপ কিছুটা স্খালন করে গুওর-কে একজন স্বাধীন অলিম্পিক ক্রীড়াবিদ (Independent Olympic Athlete) হিসাবে অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করার অনুমতি দিয়ে।

Photo by Darryl Webb / Reuters

আমি জানতে চাই না গুওর কি ফল করেছেন অলিম্পিক ম্যরাথনে। পদক হয়ত সে পায়নি। কিন্তু তবু গুওর আপনি আমার হিরো। জীবনে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষতে সদাব্যাস্ত এই আমরা কখনও আপনার লড়াইটা পুরোপুরি বুঝতে পারব না। বোঝার চেষ্টাটাও বৃথা। আপনার কাছে জীবন আর লড়াই আলাদা কিছু নয়, দুটোই আছে পাশাপাশি, হাত ধরাধরি করে। জীবনের ম্যারাথনে মাথা উঁচু করে দৌড়চ্ছেন আপনি, চিরকাল দৌড়বেনও জানি। চরৈবেতি, চরৈবেতি।।

ভোজ কয় যাহারে॥

ভোজ নিয়ে দু-কলম লিখতেই হলো। প্রবাসে আসা ইস্তক যে রেটে বিয়ে, অন্নপ্রাশন মায় শ্রাদ্ধের ভোজও মিস হচ্ছে, তাতে আর থাকা গেল না। এই ভোজ মিস্‌-এর যত খবর কানে আসে কিরকম একটা হাত নিশপিশ করে, রাগ হয়। আর এই একাবোকা জীবনে রাগ হলে কি আর করা – ইন্টারনেটাং শরণং গচ্ছামি। সেদিন ফেসবুকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বা ইউটিউব-এ দর্দ্‌ ভরা গান শুনে মনের জ্বালা মিটল না। তো কোনো একটা দাদুসঙ্গীত এর লিরিক দেখতে গিয়ে ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদের রবীন্দ্র রচনাবলীর সাইটটিতে যখন উঁকিঝুঁকি মারছি তখন বিদ্যুতঝিলিকের মত একটা আইডিয়া মাথায় এলো মাথাটা ঠান্ডা করার। একটু দাদুর লেখা ছোটোগল্পের পাড়াটা ঘুরে এলে হয়না? যেমন ভাবা তেমনি কাজ। কিন্তু, অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়। খুললাম তো খুললাম প্রথমেই ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’।iসেভেন-এইটে পরা এই ছোটোগল্পটির বিষয়বস্তু পুরো ভুলে মেরে দিয়েছিলাম। কিন্তু নামটা চেনা চেনা ঠেকতেই দিলাম মাউসের কোপ মেরে। ব্যাস, ‘ভোজ’ ফিরে এল মূর্তিমান বিভীষিকা হয়ে। অবশ্য আপনারা যারা আমার মত নন, মানে খাবারের নাম শুনলে/দেখলে বা খাবারের গন্ধ পেলেই খাবারের জন্য হাঁকুপাকু করে ওঠেন না, তারা অবশ্যই গল্পটিতে একবার ঢুঁ মেরে আস্তে পারেন। এই হল লিঙ্কiদাদুর লেখা পড়ে উপবাসী মন শান্ত হয়নি এমন মানুষ খুঁজলে বিরল বলব না, তবে খুঁজে পেলে তার সাথে আমি কথা বলব না, এই যা।

রবি ঠাকুর তো ফিরিয়ে দিলেন স্কুলজীবনে। রাগটা দ্বিগুন বেগে প্রত্যাবর্তনের হুমকি দিলেও আবারও পড়ে ফেললাম গল্পটা। মেয়ের বাপের অসহায়তা, ছেলের বাপের উন্নাসিকতা, বরযাত্রীদের অসভ্যতা বা জামাই বাবাজীর ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়া এসব ছাড়িয়েও যেটা মনে বসে গিয়েছিল সেটা হল হ্যাজাকের আলো, আটচালা, বৃষ্টি আর তার মধ্যে পাত পেড়ে খাওয়া। কি রোমান্টিক, কি রোমান্টিক! (ডায়েটপন্থীরা ভাবুন পড়াটা এখানেই শেষ করবেন কিনা, আর আমি বরং লেখাটা নিয়ে এগোই)।iবাকি আর কিছুর কথা জানিনা, কিন্তু ঐ মাটিতে পাত পেড়ে খাওয়াটা একঘর। আমার বাবা-কাকারা ছোটবেলায় এরকম কিছু ভোজ খেয়েছেন, কিন্তু আমরা নৈব নৈব চ। এই অব্দি এসে ভাবতে বসলাম আমার ছোটবেলায়ও তো ভোজভাতে এমন কিছু জিনিস ছিলো যা এখন আর দেখা যায় না। দেখি একটা ফর্দ করা যাক।

ফর্দ করতে বসে প্রথমেই যে জিনিসটা মাথায় আসে সেটা হলো মাটির ভাঁড়। অবশ্য শুধু মাটির ভাঁড় বললে কিছুই বোঝানো যায় না। তার সাথে আরো অনেক কিছু বলতে হবে। যেমন ধরুন, প্যান্ডেলটা কোথায় হতো? হ্যাঁ মশাই, প্যান্ডেলই। তখন তো আর আজকালকার মতো ‘অনুষ্ঠানবাড়ী’ ছিলো না, নিজেদের বাড়ীর ছাদ না হলে আশেপাশে কোনো একচিলতে ফাঁকা যায়গায় বাঁশ আর মোটা কাপড়ে তৈরী প্যান্ডেলেই মোধো থেকে মধুসূদন সকলেই খাওয়াদাওয়া সারত। আর ছাদে না হলে কেলো বাড়ত বই কমত না। অসমান মাটির ওপর নড়বড়ে একজোড়া ফোল্ডিং পায়া, তার ওপর একখানা কাঠের তক্তা কোনরকমে বসান। সেই টলটলায়মান সিস্টেমটির ওপর যে কিকরে ঐ মাথাভারী মাটির ভাঁড় ব্যালেন্স করে থাকত তা সে রাধামাধবই জানেন। অবশ্য, গা ঘেষাঘেষি করে পেটপূজোয় বসা জনগনের হৃৎকম্প বাড়াত আর একটি জিনিসও। যদিও উদ্দেশ্য তার মহানই থাকত, কিন্তু ওই বাঁশের খাঁচার অস্থায়ী প্যান্ডেল, সে যাবে কোথায়? খাওয়ার পরিশ্রমে শ্রান্ত তনু জুড়ানোর জন্য ব্যাবস্থা থাকতো ফ্যানের। সে ঝুলত মাথার ওপর, তবে ওই বাঁশ থেকেই। ফল? ফল ছিল গোটা প্যান্ডেলের কম্পন। আর সেই ‘কাঁপাকাঁপি’ পরিবেশকে আর মোহময় করত দু একটি নিতান্তই বালক/বালিকা। তাদের না পা পৌছত মাটিতে, না হাত ভাঁড় অব্দি। কিন্তু মোহময়ী খাদ্যবস্তু যখন ঝালের মাধ্যমে জিহ্বার স্বাদকোরকগুলিকে নিতান্ত পীড়ন করত তখন সে সব ভুলে বাড়াত সেই ভাঁড়ের দিকে হাত। আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সূচনা হত জল-টল পড়ে এক ক্যাডাভ্যারাস্‌ কান্ডের।

উৎসঃ ইন্টারনেট।

এতো গেলো পানীয়র ব্যাপার। এবার আসি সলিড খাবারদাবারের কথায়। এইসব খাবার দিত কোথায়? ঠিক ধরেছেন, ‘শালপাতা’য়। অবশ্য ছবিতে যেরকম দেখাচ্ছে প্রথমদিকে এত সুবিধাজনক অবস্থায় এনাকে ঠিক পাওয়া যেত না। ইনি তখন থাকতেন কিছুটা মুক্তকচ্ছ অবস্থায়, মানে ওই কানাউঁচু গল্পটা ছিলনা। আর সেসব পাতায় থাকত অজস্র ছ্যাঁদা। সেই ছ্যাঁদা গলে মূল্যবান খাদ্যবস্তুর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি আটকাতে তলায় আরেকটা করে পাতা দেওয়া হতো। ডাবল কভার আরকি। কিছু বেয়ারা ভাতের কণা যে ঝোলঝাল সমন্বিত হয়ে দুটি পাতার মাঝখানে ঠাঁই নিত না এমনটা বলা যায় না, তবে নিমন্ত্রিত মশাইরা এই তুচ্ছ ব্যাপারটা খুব একটা পাত্তা দিতেন না। তারা বরং থালার ওপরের বিপুল খাদ্যসম্ভার ভুলে মাঝেসাঝে ওপরের থালার ছোট ছোট পাতার ফাঁকে আটকে যাওয়া খাবারের কণা বের করতে প্রচন্ড উৎসাহী হয়ে পরতেন। সে সাফল্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার আগেই যে ব্যাপারটা ঘটতো সেটা আরো মারাত্মক। বেয়ারা খাবারকে সোজা করতে গিয়ে উনি তো স্লো হয়ে পরেছেন, এতক্ষণে ডাল দিয়ে চাড্ডি ভাত মাখিয়ে খাচ্ছেন। এমন সময় প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে পাতে পড়ল চাটনি। পড়ল তো পড়ল, কিন্তু তাকে পাতার উপত্যকা বেয়ে, অন্যান্য খাদ্যবস্তুর ফাঁক গলে, ডালে এসে মিশতে কে বলেছিল রে বাবা! কাজেই পাতার কল্যানে, ডাল যেমন হয়ে উঠত টক বা মিষ্টি তেমনি মাছ হয়ত বা হয়ে উঠত দই-মাছ। বিবর্তনের ফলে শালপাতা হোলো কানাউঁচু, তাতে কাঠির বদলে লাগলো সুতো আর ঝাড়াই বাছাই করা পাতা হয়ে উঠল প্রায় ছিদ্রবিহীন। তাতে খাওয়াটা একটু ‘সভ্যভব্য’ হোলো বটে, তবে নেমন্তন্ন খাওয়ার রোমাঞ্চটা যে দশগুণ কমে গেল সেটা বলাই বাহুল্য। আর আজকের থার্মোকল বা বোনচায়নার যুগে – উও বাত কাঁহা?

এইবেলা আমার শালপাতা প্রেম নিয়ে দু-একটা কথা সেরে রাখি। নেমন্তন্ন হোক বা বাড়িতে খাওয়া ‘শালপাতায় খাব’ – এই ব্যপারটা আমার বেজায় ভালো লাগতো। বাড়িতে অবশ্য, বুঝতাম না কেন, শালপাতা ব্যাপারটাকে খুব একটা এনকারেজ করা হত না। ব্যাপারটা সুবিধেজনক বলেই তো আমার ধারণা। মাজামাজির ঝামেলা কিছুটা হলেও তো কমে। যাই হোক, রোজকার থোড়-বড়ি-খাড়ার দিনে যখন শুনতে পেতাম কাজের দিদা বলছে, “অ বউমা, বড়বিটির ব্যাটাটার শরীরটা ঠিক যেছে না। সামনের হাটবারের পর একটু লাতির কাছে যাব। তোমার কষ্ট হবে না তো মা দুদিন চালিয়ে নিতে?” তখন মায়ের বা কাজের দিদার নাতি কারও কষ্টেই ঠিক দুঃখ পেতাম না। মায়ের কষ্টের কিছুটা সুরাহা করতে বাবা ঠিক শালপাতা নিয়ে হাজির হতো। আর আমায় পায় কে, আনন্দে দু-গ্রাস ভাতও বেশি খেয়ে ফেলতাম। আর একটা ঘটনার কথা এখানে না বললেই নয়। প্রাইমারী স্কুলে পড়াকালীন একবার এক সম্পর্কিত দাদু কাম শিক্ষক আমাদের শীতকালে চড়ুইভাতি করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের ঠিক বাইরেটিতেই। যথাসময়ে সব শেষ হলে সবাই রওনা দিলাম হেঁটে বাড়ির পথে। আমার চোখ ছিল বেঁচে থাকা শালপাতাকটির ওপর। আহা, কয়েকটা শালপাতা বাড়ি নিয়ে গেলে মা কি আর আমায় ওই শালপাতাকটিতে কয়েকদিন খেতে দেবেন না? বেশ ফুরফুরে মনে শালপাতা দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটছিলাম, এমন সময় তাল কাটল কয়েকটি মেঠো কাচ্চাবাচ্ছা। আমায় দেখিয়ে বলে কিনা, “একে নির্ঘাত খেতে দেয়নি, তাই দুটো শালপাতা ধরিয়ে দিয়েছে”।iকি লজ্জা কি লজ্জা। প্রাণে ধরে দিলাম ফেলে সাধের শালপাতা।

আরেকটা বিশাল পরিবর্তন হয়েছে খাওয়া বা খাওয়ানোর পদ্ধতিতে। এখন হয় ‘বাফে’ না হয় টাই পরা ক্যাটারার। আর তখন ভোজে, পাড়া বা ক্লাবের ছেলেরাই থাকত পরিবেশনের দায়িত্বে। খাওয়ানো শুরু হয়ে গেলে তারাই আসরের কর্তা। গৃহকর্তাকে শুধু মাঝে মাঝে দু একজন সর্দার গোছের পরিবেশনকারীর কানে কানে, “বাচ্ছাদের একটু সামলে সামলে দিস। ওরা নষ্ট করে প্রচুর।“ – এই ধরনের দু একটা কথা বলা ছাড়া আর কিছু ভাবতে হতো না। আর তারাও জায়গা বুঝে মোলায়েম হাসি সহযোগে ‘দাদা আর একটু দিই’ বা ‘বৌদি কিন্তু ঠিক করে খাচ্ছেন না’ বা একটু চোখ পাকিয়ে ‘বিল্টু, মাছটা শেষ করতে হবে কিন্তু’ বলে ঠিক কাজটা উদ্ধার করে দিতো। পোষাকের মধ্যে আর যাই থাক না কেন, কটিদেশে গামছা একখানি ঠিকই ঝুলত তাদের। আর পারিশ্রমিক বলতে ছিল দিনকয়েক পরে একটু কবজি ডুবিয়ে খাওয়া। কচি বয়সে এদের অবশ্য বেশ ভয়ই পেতাম। এরা তুষ্ট হলে তবেই না ঠিকঠাক ‘ভোজ’ জুটবে কপালে। আরো কারণ ছিলো অবশ্য। যেমন আমাকে এরা কোনদিনই ভোজে জল পরিবেশনকারীদের ‘এলিট’ দলে রাখার যোগ্য মনে করেনি। দ্বিতীয় কারনটা আরও মর্মান্তিক। কোনদিনই আমার একটা করে পান আর একটা করে আইসক্রিমে পোষাত না। আর এরা আমায় সেই সু্যোগটাই দিতো না। অগত্যা মা-বাবার কাছে ভালো ছেলে হয়ে থাকার কড়ারে এডিশনাল পান বা আইসক্রিম হাতাতে হতো। এখনকার এই ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ মার্কা ভোজে (মানে ‘বাফে’তে) কি আর এই রোমাঞ্চ পাওয়া যায়? জানিনা।

যাকগে, অনেক বকে ফেললাম। নটে গাছখানা এবার মুড়োই। স্বর্গীয় জগ্‌জিৎ সিংহের গাওয়া এই গানখানি শুনতে শুনতে আপনারাও একটু ছেলেবেলাটাকে ফিরে দেখুন আর আমার সাথে শেয়ার করুন সেই গল্পকথা। ভালো থাকুন সকলে।